ঝিঙে পটল (ধারাবাহিক, ষষ্টদশ পর্ব) : দিলীপ রায় (+৯১ ৯৪৩৩৪৬২৮৫৪)।

0
443

ঝিঙে নিজেকে গুটিয়ে রাখতে পারলো না । মাঝখান থেকে তার পড়াশুনায় প্রচুর ঘাটতি হয়ে গেলো । যার জন্য উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা ভাল দিতে পারলো না । পটলের মানসিক শান্তি, “শেষ পর্যন্ত বোনটা পরীক্ষা দিয়েছে ।“ বোনটা পরীক্ষায় বসেছে তাতেই পটলের শান্তি । পরীক্ষার রেজাল্ট কী হবে সেই বিষয়ে পটল একটুও ভাবিত নয় । তার দৃঢ় বিশ্বাস, বোন যখন পরীক্ষায় বসেছে পাশ সে করবেই ।
উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হয়ে যাওয়ার পর বোনকে নিয়ে পটল পুরীতে বেড়াতে গেলো । পটলের ধারণা, পুরীর সমুদ্রের পারে বেড়ালে বোনের মনোবল বাড়বে । স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে পাবে ।
তারপর হাওড়া থেকে ট্রেনে সোজা পুরী । সেখানে সমুদ্রের পারে হোটেল ভাড়া করলো । পুরীতে পৌঁছে ঝিঙে অনেক সাবলীল । সমুদ্রের পার দিয়ে বেড়াতে তার ভীষণ উৎসাহ । বোনের উৎফুল্লতা লক্ষ করে পটল খুব খুশী । বেড়াতে কিছু টাকা খরচ হচ্ছে বটে, কিন্তু বোনটার মুখে প্রাঞ্জল হাসি দেখে তার চিত্তে সুখ । যেটার জন্য পটল মুখিয়ে ছিলো, সেই বোনের মুখে প্রশান্তির হাসি দেখে পটল যারপরনাই আনন্দিত । যাই হোক ভাই বোন দুজনে মিলে এলোপাথাড়ি ঘুরছে । পটলের জীবনে প্রথম কোনো ভ্রমণস্থলে বেড়াতে আসা । যার জন্য পটলও পুরীতে বেড়িয়ে খুব আনন্দ পাচ্ছে ।
পরেরদিন সকালবেলায় স্নান সেরে, জগন্নাথের মন্দিরে পুজো দিতে ছুটলো । মন্দিরে পাণ্ডাদের হাতে তুলসী পাতা দেখে ঝিঙের খুব কৌতুহল, “দাদা, সমস্ত পাণ্ডাদের হাতে তুলসি পাতা কেন ?” পটলের এই ব্যাপারটা কিছুই জানা নেই । তবুও বোনটার কৌতুহল দমন করার জন্য একজন বয়স্ক পাণ্ডাকে ব্যাপারটা জিজ্ঞাসা করায় তিনি বললেন, তুলসী পাতা জগন্নাথ দেবের ভীষণ প্রিয় ।
পুরীর আশেপাশে বেড়িয়ে ঝিঙে যেমন খুশী, তেমনি পটলও খুব খুশী ।
অবশেষে পটল ও ঝিঙে পুরীতে তিনদিন ও তিনরাত কাটানোর পর বাড়ি ফিরলো । বাড়ি ফেরার পর ঝিঙে অনেক উৎফুল্ল । হাসি খুশী । সকলের সঙ্গে প্রাণখোলা কথাবার্তা । ঘোরাফেরায় কোনো আড়ষ্ঠতা নেই । একদম স্বাভাবিক । ঝিঙে ক্রমশ আগের চালচলন ও জীবনযাপনে ফিরছে । বোনের স্বাভাবিক জীবনযাপন দেখে পটল আনন্দে আত্মহারার ন্যায় । তাই দোকান নিয়ে পটল এবার ধ্যান দিলো ।
দোকানটা বাজারসৌ স্টেশন চত্বরে খুব জনপ্রিয় । মোটামুটি প্রয়োজনীয় সব জিনিস এখন পটলের দোকানে পাওয়া যাচ্ছে । যার জন্য তার দোকানে খরিদ্দারদের ভিড় অহরহ ।
“দাদা, আপনার দোকানে গায়ে মাখা সাবান পাওয়া যাবে ।“ কুন্তী জানতে চেয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে পটলের দিকে তাকিয়ে রইলো । কুন্তীর তাকানোর কায়দা অন্যরকম । প্রথম দিনেই ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে পটলের আপাদমস্তক সম্বন্ধে তার একটা ধারণা জন্মালো ।
“গায়ে মাখা সাবানের নাম কী ?” পটল কুন্তীর দিকে তাকিয়ে পাল্টা জানতে চাইলো ।
“আপনি কেমন দোকানদার ! গায়ে মাখা সাবান রাখেন না । আবার নাম জিজ্ঞাসা করছেন ?“ কুন্তীর আড় চোখে অভিযোগ ।
“সাবান অন্তত ছয়-সাত ধরনের রয়েছে । কোন সাবানটা চাইছেন বললে আমার পক্ষে সুবিধা হত । গায়ে মাখা সাবানের দামটাও একটু বেশী ।“ পটল বোঝাতে চেষ্টা করলো ।
অতশত বুঝি না । আমাকে একটা ভাল গায়ে মাখা সাবান দিন ।
আচ্ছা মুশকিল ! তাহলে কী ডাভ্‌ সাবান দেবো ?
বললাম তো, ভাল সাবান দেবেন ।
এইবার ডাভ্‌ সাবান বের করে কুন্তীর দিকে বাড়িয়ে চোখে চোখ রেখে পটল বলল, “আপনার বাড়ি কোথায় ? ইতিপূর্বে আপনাকে এই চত্বরে কখনও দেখিনি ।“
এতদিন দেখেননি । এবার থেকে দেখবেন ।
কিন্তু আপনার মতো দুই-চারটে খরিদ্দার দোকানে এলে দোকানের বেচাকেনা মাথায় উঠবে ?
“আমার সম্বন্ধে আপনার অহেতুক খারাপ ধারণা হচ্ছে কেন ?” কুন্তী পটলকে জিজ্ঞাসা করলো ।
খারাপ ধারণা নয় । একটা সাবান কিনতে আপনি যা করলেন অন্যেরাও সেটা করলে দোকানের কাজকর্ম শিকেয় উঠবে, সেটাই বললাম ।
কুন্তী চলে গেলো । কিন্তু দোকান ছাড়ার আগে এক ঝলক হাসি দিয়ে কুন্তী বলে গেলো, সে পুনরায় আসবে ।
পটল কুন্তীকে দেখে একটু ভড়কে গিয়েছিল । মেয়েটা দেখতে খাসা ! সুন্দরী না হলেও গায়ের রঙ অতটা চাপা নয় ! স্লীম চেহারা । স্পষ্ট উচ্চারণে কথা বলে । কিন্তু কুন্তী মেয়েটা কে ? কোনোদিন তাকে এই চত্বরে দেখেনি । পটল নিজেও ভাবছে, বোনকে বড় করতে গিয়ে সেই অর্থে কোনো মেয়ের দিকে তাকায়নি বা কোনো হাল্কা বয়সের মেয়ের খপ্পরে পড়েনি । ফলে মেয়েদের সাথে মেলামেশায় পটল একেবারেই অনভিজ্ঞ । বলা চলে কাঁচা । কিন্তু কুন্তীকে দেখার পর একটু হলেও পটলের মনে তার জন্য আলোড়ন সৃষ্টি হল । তবে এইসব মনের সাময়িক পরিবর্তনকে পটল গুরুত্ব দিতে নারাজ ।
“পটল, একটু আদা দিয়ে কড়া করে চা বানাও ?” দিগন্তবাবু হন্তদন্ত হয়ে কোথা থেকে এসে পটলের দোকানে রাখা চেয়ারে বসে চা চাইলেন ।
“চিনি কী দেবো কাকা ?”
না, একদম চিনি দেবে না । চিনি খাওয়া ছেড়ে দিলাম, পটল । সুগারটা বেড়েছে । আর তা ছাড়া তোমার কাকীমার কড়া নির্দেশ, মিষ্টি খাওয়া চলবে না ।
চা বানিয়ে পটল দিগন্তবাবুর সামনে হাজির । বাজারসৌ তল্লাটে দিগন্তবাবুকে সবাই চেনে । তিনি একজন অবসরপ্রাপ্ত হাই স্কুলের শিক্ষক । তবে বয়স সত্তরের কাছাকাছি । ইতিমধ্যে হার্টের সমস্যায় কিছুদিন ভুগলেন । এলাকার মানুষ তাঁকে ভীষণ শ্রদ্ধা করে ।
খবরের কাগজে চোখ বোলাচ্ছিলেন দিগন্তবাবু ।
“কাকা চা !” পটল চায়ের কাপটি এগিয়ে ধরলো ।
পটলের ডাকে পেপার থেকে মুখটা তুলে মাস্টার মশাই বললেন, “দাও বাছা ! অনেকক্ষণ যাবৎ চা খাওয়া হচ্ছে না । বাড়িতে চা চাইতেই, তোমার কাকীমার চোখ রাঙানি ! সকালে বিকালে ছাড়া তাঁর চা দিতে আপত্তি । তাই সোজা তোমার দোকানে আসা ।“
চায়ে চুমুক দিয়ে দিগন্তবাবু বললেন, “খাসা চা বানিয়েছো বাছা !”
বিস্কুট কী দেবো কাকা ।
না, আর বিস্কুট দিতে হবে না ।
চা খেয়ে দিগন্তবাবু চলে যাওয়ার সময় জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমার বোন উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা কেমন দিলো ?”
ভাল দিয়েছে কাকা ।
“ভাল দিয়েছে শুনে খুব খুশী হলাম । ওর উপর দিয়ে যা ঝড় বয়ে গেলো তাতে পরীক্ষা ভাল হওয়ায় আমি আনন্দ পেলাম । চলি বাছা !” বলেই তিনি চলে গেলেন ।
বেশ কয়েকদিন দোকান নিয়ে ব্যস্ত রইলো পটল । ঝিঙেও মাঝে মধ্যে দোকানে এসে দাদাকে সহযোগিতা করছে ।
ঝিঙের পরীক্ষার রেজাল্ট বের হতে বেশ কিছুদিন বাকী । তাই পটল বাড়ি তৈরীর কাজে হাত দিলো । আরও একটা ঘর দরকার । ছোট ঘর । বোনটার জন্য বিশেষভাবে ঘরটা দরকার । তাই নতুন একটা ঘর শুরু করলো । দুই মাস লেগে গেলো ঘরটা তুলতে । একেবারে শেষ পর্যায়ে কিছু টাকার জন্য আটকে গেলো । ইটের গাঁথনিটার প্লাস্টার ও রঙ করতে অনেক টাকার দরকার । দোকানে যা বেচাকেনা, তাতে লাভের অংশ খুব কম । পটলের উদ্বিগ্নতা লক্ষ্য করে ঝিঙে দাদাকে কিছুদিনের জন্য নির্মাণ বন্ধ রাখতে পরামর্শ দিলো । টাকার সংস্থান হলে বাকী কাজ করা যাবে ।
কয়েকদিন থেকে কানাঘুষো, উচ্চ মাধ্যমিকের ফল খুব শীঘ্র বের হবে । বোনটার রেজাল্ট নিয়ে পটল খুব দুশ্চিন্তায় রয়েছে । বোনের পরীক্ষার রেজাল্ট বের হলে কলেজে ভর্তি করার ঝকমারি রয়েছে । তাই সে চিন্তিত !
দুপুরের খাওয়ার পর সেজেগুজে ঝিঙে কোথাও বের হচ্ছে । পটলের কাছে এসে আবদার ধরলো, “দাদা আমাকে পাঁচ শত টাকা দিবি ?”
হঠাৎ এত টাকা কেন বোন ?
আমার বান্ধবী শ্রীলেখার জন্মদিন । তার জন্মদিনে উপহার কিনে দেবো ।
“তুই একটু বোস । আমি ঘর থেকে টাকাটা আনছি ।“ তারপর পটল ঘরে ঢুকলো ।
টাকাটা ঝিঙের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বোনের মাথায় হাত দিয়ে বললো, “দিনের আলোতে বাড়ি ফিরিস্‌ ।“
মাথা নেড়ে ঝিঙে জবাব দিলো, “তুমি আমার জন্য চিন্তা করো না । আমি খুব তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরবো ।“
তারপর ঝিঙে একটা টোটো ধরে শ্রীলেখার বাড়ি উঠলো । তাকে দেখে শ্রীলেখা অবাক ! জন্মদিনের অনুষ্ঠানটা হবে সন্ধ্যাবেলায় । কিন্তু বিকাল চারটের সময় ঝিঙে উপস্থিত । উপহারটি শ্রীলেখাকে ধরিয়ে দিয়ে ঝিঙে শুভেচ্ছা জানিয়ে বলল, “শুভ জন্মদিন । এইদিনটি তোর জীবনে বার বার আসুক ।“
শ্রীলেখা তার পড়ার ঘরে ঝিঙেকে বসালো । পেছন পেছন শ্রীলেখার মা উপস্থিত । শ্রীলেখার মা বললেন, “তোর এই বান্ধবীকে কী দুস্কৃতিরা তুলে নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলো ?”
শ্রীলেখার তার মায়ের কথার মর্ম উপলব্ধি করে বলল, “মা, ঝিঙে আমার ভাল বন্ধু । তাই সে জন্মদিনে আমাকে শুভেচ্ছা জানাতে বাড়িতে ছুটে এসেছে ।“
কিন্তু ঝিঙে শ্রীলেখার মায়ের কথার জবাবে বলল, “হ্যাঁ মাসিমা । আমাকে দুস্কৃতিরা তুলে নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলো । তবে ওটা আমার পরিচয় নয় । আমার পরিচয়, আমি শ্রীলেখার বান্ধবী ।“
শ্রীলেখার মা বেজার মুখে ঘর ত্যাগ করলেন ।
ফ্যাকাশে মুখে ঝিঙে ভাবছে, সমাজের চোখে সে এখন শ্রীলেখার বান্ধবী নয় । একজন ছাত্রীও নয় । পটলের বোন নয় । তার পরিচয়, দুস্কৃতিদের হাতে অপহৃত এক যুবতী মেয়ে । শ্রীলেখার মায়ের কথা যত ভাবছে, ঝিঙে মনোকষ্টে ততই পীড়িত হচ্ছে । তার নিজের পরিচয় ক্রমশ লুপ্ত হওয়ার পথে ! অথচ দাদার কষ্টকর পরিশ্রমের টাকায় দামী একটা উপহার নিয়ে হাজির হল, সেটা শ্রীলেখার অভিভাবকদের কাছে ধর্তব্য নয় । তাঁরা বড় করে ধরলেন, ঝিঙের অপহরনের ঘটনাটা !
ঝিঙের আর শ্রীলেখাদের বাড়িতে বসে থাকতে মন চাইলো না । জরুরি কাজের অছিলায়, কিছু না খেয়ে শ্রীলেখাদের বাড়ি থেকে সোজা বাড়ি । বাড়ি ফিরে গোমড়া মুখে ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লো । বোনের ফ্যাকাশে মুখ দেখে পটল গভীর চিন্তায় পড়ে গেলো । কোনো অঘটন ঘটলো কিনা, সেটা বোঝার জন্য ছুটে বোনের পাশে বসলো । তারপর তার মাথায় হাত দিয়ে বলল, “তুই এত চুপচাপ কেন ?”
দাদার কোলে মাথা রেখে ঝিঙের ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না !
বোনকে কিছুতেই সংযত করা যাচ্ছে না । তাই পটল ভাবলো, টিভি চালালে যদি বোনের দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরানো যায় । টিভি চালিয়ে দিলো পটল ।
তখন টিভিতে খবর চলছে । টিভির দিকে যেমনি পটলের দৃষ্টি, তেমনি ঝিঙেরও দৃষ্টি । খবর চলছে, “আগামীকাল উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার রেজাল্ট !”
ঝিঙের কান্না তখন থেমে গেছে । পরক্ষণেই উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলো রেজাল্ট জানার জন্য !
 ( চলবে )