তেলাপিয়া মাছ ছাষ করে লাভবান হন।

0
233

তেলাপিয়া মাছ আমাদের সাধারণের বাজারে ৬০-এর দশকে যখন আমদানি হতে থাকে তখন এই মাছের চাহিদা তেমন ছিল না। নানা রকম অপপ্রচার ছিল (যেমন এই মাছ খেলে বুদ্ধির বাড়বাড়ন্ত হবে না ইত্যাদি)। বাজারে এই মাছের চাহিদা যেমন ছিল না, দামও তেমনই কম ছিল। এর চাষ পদ্ধতি, এর প্রজনন ও খাদ্যভ্যাস চাষির অনুকূলে থাকার কারণে এর চাষ বন্ধ হওয়ার পরিবর্তে বেড়েই চলেছে।

তেলাপিয়া মাছ একটু চওড়া, বেঁটে, বলিষ্ট গঠনের। মাথা বেশ শক্ত ও মোটা। অনেকটা কৈ বা খলসে মাছের আকৃতির মাছ। ৫০ গ্রাম থেকে ৫০০ গ্রাম ওজনের এই মাছ বাজারে আসে ও কেনাবেচা হয়। এই মাছের মাংসে ছিবড়ে ভাব কম থাকায় বেশ নরম। বেশি কাঁটা নেই। মাছ বেশ সুস্বাদু, কিন্তু কারও কারও কাছে বেশ অপছন্দের। ঈষৎ গন্ধ থাকায় রুই, কাতলার মতো কালিয়ার পরিবর্তে ভাজা বা স্বল্প ঝোলওয়ালা তরকারিই মৎস্যভুকের বেশি পছন্দের। আজকাল তেলাপিয়া মাছের চাহিদা বাজারে অন্যান্য সাধারণ মাছের মতোই হয়ে উঠেছে। এই মাছ আমাদের পশ্চিমবঙ্গের বাজারে অন্যান্য মাছের মতো বাইরে থেকে আমদানি করতে হয় না। এর প্রজনন খুব সহজ। নিজের খামারের জলাশয়ে এদের প্রজননক্রিয়া সম্পন্ন হয়, বংশবৃদ্ধি হয়। তাই সাধারণ চাষিদের অনেকেই এই সুযোগ নিয়ে থাকেন। অবশ্য ভালো ফলন পেতে হলে আঁতুড়-পুকুর, পালন-পুকুর, মজুত-পুকুর একাকার করলে চলবে না। এদের খাদ্যাভ্যাস ও প্রকৃতি সাধারণ বা প্রান্তিক চাষিদের চাষের অনুকূল। এরা বস্তুত আমিষভোজী, কিন্তু যে কোনও খাবার এরা খায়। যে কোন পরিবেশে এরা নিজেদের টিকিয়ে রাখতে পারে। বেশ নোংরা জল বা সাধারণ দূষিত জলেও এদের চাষ করা যায়। অনেক সময় জলাশয় পরিষ্কার করা বা দূষণ মুক্ত করার জন্যও এই মাছ চাষ বেশ উপযোগী।

বর্তমানে তেলাপিয়া মাছের চাহিদা বেশ বেড়ে গেছে। এই মাছের কাঁটা কম, নরম মাংস ও জীবন্ত অবস্থায় বাজারে সহজেই পাওয়া যায়। তাই আবালবৃদ্ধবনিতা নির্বিশেষে অনেক বাড়িই এই মাছ বেশ পছন্দ করে। এদের রোগ-পোকা প্রতিরোধক্ষমতা বেশি, তাই রোগ-পোকা খুব হয়ও না। তেলাপিয়া মাছ স্বয়ং বংশবিস্তারক। এদের প্রজননের জন্য আলাদা করে কৃত্রিম ব্যবস্থার কোনও ঝুঁকি না নিলেও চলে। কিন্তু এই স্বয়ং বংশবিস্তারের কিছু কুফল আছে তেলাপিয়া মাছ চাষে ভালো উৎপাদন পেতে। মজুত-পুকুরেই এদের প্রজননক্রিয়া সম্পন্ন হলে পুকুরে মাছের সংখ্যা, বয়স, আকৃতি – কোনও কিছুর উপরেই কোনও নিয়ন্ত্রণ থাকে না। ফলে জলাশয় নির্বাচন ও মাছের দেখভাল, খাদ্য প্রয়োগ থেকে শুরু করে মাছ ধরা ও বাজারজাত করা — সব কিছুতেই একটা বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। এ সবই হয়ে যায় চাষির অজান্তে। তাই যদি একলিঙ্গ তেলাপিয়া মাছ চাষের ব্যবস্থা করা হয়, তা হলে এই চাষ লাভজনক করতে হলে চাষিকে এই অসুবিধাগুলো কাটিয়ে উঠতে হবে।

এই চাষে শুধু স্ত্রী মাছ বা পুরুষ মাছ একক ভাবে চাষ করা হলে তাকে মোনোসেক্স তেলাপিয়া চাষ বলে। মৎস্যভুকের কাছে পুরুষ তেলাপিয়াই বেশি পছন্দের এবং পুকুরে এই পদ্ধতি নিয়ন্ত্রণে বেশি সুবিধা। তাই মোনোসেক্স তেলাপিয়া চাষে পুরুষ বাচ্চা পুকুরে ছেড়ে ও পালন ও মজুত করা হয়ে থাকে। সেই জন্য মোনোসেক্স তেলাপিয়া চাষ বলতে আমরা একক ভাবে শুধু পুরুষ তেলাপিয়া মাছ চাষ বুঝি। এরা সম্পূরক খাদ্যগ্রহণে অভ্যস্ত, এরা প্রতিকুল পরিবেশেও টিকে থাকতে পারে। অধিক ঘনত্বেও চাষ করা যায়। এই ভাবে চাষ করলে প্রজননের জন্য পুকুরের পাড়ে গর্ত করে না। চাষিদের মধ্যে এই চাষের প্রবণতা উত্তরোত্তর বাড়ছে।

চাষের পুকুর নির্বাচন

এই চাষ নির্বাচিত পুরুষ-চারা সংগ্রহ করে করা হয় এবং এরা স্বয়ং প্রজননক্ষম। তাই এই চাষের জন্য সাধারণত দু’ রকম পুকুরের ব্যবস্থা রাখা হয়।

লালন-পুকুর ও পালন পুকুর

পুকুরে জলের গভীরতা অন্তত ৪৫ সেন্টিমিটার থেকে ১২৫ সেন্টিমিটার (১.৫ ফুট থেকে ৪ ফুট) হওয়া প্রয়োজন।
পুকুরের পাড়সমূহ মজবুত হওয়া প্রয়োজন। এই মাছের অনেক সময় পুকুরের পাড়ে গর্ত করার প্রবণতা থাকে।
বন্যার হাত থেকে এদের বাঁচাতে হবে। সুযোগ পেলেই এদের অন্যত্র পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা থাকে।
পুকুরে পর্যাপ্ত সূর্যালোক থাকা দরকার। এদের সংখ্যায় একটু বেশি রাখা হয় এবং এদের শ্বাস–প্রশ্বাসের জন্য একটু বেশি অক্সিজেনের প্রয়োজন হয়। তাই লক্ষ রাখতে হবে যেন আলো-বাতাসের তেমন ঘাটতি না ঘটে। বিশেষ করে সকালের সূর্যালোক খুবই দরকার।
পুকুর জলজ উদ্ভিদ ও আমাছা শূন্য হওয়া ভালো।

লালন-পুকুর ও পালন পুকুর প্রস্তুতি।

উপযুক্ত মাপের পুকুর নির্বাচন বা খননের পর পুকুরটিকে জলশূন্য করতে হবে। অথবা অবাঞ্ছিত পোকামাকড় বা আমাছা নিশ্চিহ্ন করার জন্য মহুয়া খৈল প্রয়োগ করতে হবে।
এর পর (৭ / ১০ দিন পরে ) পুকুরে বিঘা প্রতি ৩০ কেজি কলিচুন, ১৫০ – ১৬০ কেজি গোবর এবং ৩ থেকে সাড়ে ৩ কেজি করে ইউরিয়া ও সিঙ্গল সুপার ফসফেট ও ৬০০ গ্রাম মতো মিউরিয়েট অফ পটাশ প্রয়োগ করতে হবে (প্রতি হেক্টরে ১১২৫ – ১১৫০ কেজি গোবর, ২২৫-২৫০ কেজি চুন, ২২-২৫ কেজি করে ইউরিয়া এবং ৪.৫ – ৫ কেজি মিউরিয়েট অব পটাশ)। পুকুরের পাড়ের চার দিকে জাল দিয়ে ঘিরে বা এমন ব্যবস্থা করতে হবে যেন ব্যাঙ বা সাপের উপদ্রব না হয়। কারণ এরা উভয়েই এদের শত্রু।

সার প্রয়োগের অন্তত ৭ / ১০ দিন বাদে ২১ – ২৮ দিন বয়সের চারা মাছ ছাড়তে হবে। ৩০,০০০ – ৫০,০০০টি বিঘা প্রতি (হেক্টর প্রতি ২২০০০০ – ৩০০০০০টি) মাছের চারা সংগ্রহ থেকে শুরু করে পুকুরে প্রয়োগ, সবই সাধারণ নিয়মনীতি মেনে করতে হবে। এখানে এগুলিকে ৪০ – ৬০ দিন অবধি রাখা হয়। এই সময় এদের খাদ্যের চাহিদা খুব থাকে। তাই প্রাকৃতিক খাবারের সঙ্গে সঙ্গে পরিপূরক খাবারও দিতে হয় যথেষ্ট পরিমাণে। এদের গড়পড়তা ওজনের ১০ – ১৫ ভাগ খাবার দিতে হবে। এই খাবার সারা দিনে ৩ – ৪ বারে দিলে খাবারের ভালো সদ্ব্যবহার হয়। যে হেতু এরা আমিষভোজী এই খাবার আমিষসমৃদ্ধ হওয়া উচিত অর্থাৎ খাবারে অন্তত ৩০% -৩৫% প্রোটিন থাকতে হবে। এখানে এদের ওজন ২০ – ৩০ গ্রাম হলে মজুত পুকুরে চালান করে দেওয়া হয়।

তেলাপিয়া চাষের জন্য পুকুরে জলের গভীরতা কোনও সমস্যা নয়। বেশি গভীর জলাশয়েও এই মাছের চাষ সম্ভব।

পালন-পুকুরে তৈরি মাছের চারা এই জলাশয়ে ছাড়ার আগে সাধারণ নিয়মনীতি মেনে পুকুর তৈরি ও পরিষ্কার করতে হবে, আগাছা-আমাছা মুক্ত করতে হবে। তার জন্য প্রয়োজনবোধে বারবার জাল টানা দরকার বা জল শুকিয়ে অথবা রোটনেন ওষুধ প্রয়োগ করে বা মহুয়া খৈল প্রয়োগ করে এই উদ্দেশ্য সমাধান করতে হবে।
পরিমাণমতো চুন, কাঁচা গোবর, ইউরিয়া, সুপার ফসফেট ও মিউরিয়েট অব পটাশ (পালন-পুকুরের মতোই) প্রয়োগ করতে হবে।
সার প্রয়োগের পর ৭ / ১০ দিনের মধ্যে যথেষ্ট প্রাকৃতিক খাবার তৈরি হয়ে যাবে। এই বার পালন-পুকুরে লালিতপালিত চারা মাছ (২০-৩০ গ্রাম ওজনের) ৪,৫০,০০০ – ৫,০০,০০০ প্রতি হেক্টরে ছাড়তে হবে (৬,০০০ – ৮,০০০ প্রতি বিঘায়)।
পুকুরে যাতে প্রাকৃতিক খাবারের ঘাটতি না হয় তার জন্য ৭ দিন বাদে বাদে বিঘা প্রতি ১০০ – ১৫০ কেজি গোবর, ৫০ – ৬০ কেজি মুরগির বিষ্ঠা, ১ কেজি করে ইউরিয়া ও সিঙ্গল সুপার ফসফেট দিতে হবে। তবে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। যথেষ্ট খাবার তৈরি হয়ে গেলে এই সার বন্ধ করতে হবে বা কমাতে হবে।
মাছের গড় ওজন ১০০ গ্রাম বা ততোধিক হলেই পুকুরের কিছু জল (শতকরা ৫ – ১০ ভাগ) পরিবর্তন করতে পারলে ভালো হয়।
মজুত-পুকুরে ১০০ – ১২০ দিন থাকার পর মাছের গড় ওজন ২০০ – ২৫০ গ্রাম হয়ে যায়। তখন থেকেই মাছ ধরা যেতে পারে। মাছের ওজন ৩০০ – ৫০০ গ্রাম হলে সুযোগ বুঝে সমস্ত মাছ তুলে বাজার জাত করা উচিত।
খাদ্য
তেলাপিয়া মাছ আমিষভোজী। জলাশয়ের জুপ্লাঙ্কটনই এদের বেশি পছন্দের খাবার। বস্তুত এরা সব খাবারই খায়, পচাগলা প্রাণীদেহ থেকে শুরু করে নানা রকম নোংরা খাবার। সেই কারণে পুকুরে মাছের প্রাকৃতিক খাবার বাড়াবার উদ্দেশ্যে নিয়মিত চুন ও সার প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। এ ছাড়া এদের খাদ্যের চাহিদা পূরণের জন্য পরিপূরক খাবারও পুকুরে প্রয়োগ করা হয়। এই খাবার আমিষসমৃদ্ধ হতে হবে। তাই পরিপূরক খাবারে খৈল, সস্তার মাছের গুঁড়ো, ডাল জাতীয় উপাদান মিশ্রিত থাকে। খামারের নানা বর্জ্য পদার্থ যেমন গৃহপালিতদের বিষ্ঠা, পরিত্যক্ত দানা, ছাগল-মুরগির নাড়িভুঁড়ি ইত্যাদি।

।।সংগৃহীত।