বাংলা অভিনয় জগতের বলিষ্ঠ অভিনেতা অভ্রজিৎ চক্রবর্তীর শুভ জন্মদিনে স্মৃতিচারণ করলেন বাংলা ব্যান্ড ভ্রূণের অন্যতম সদস্য অনিরূদ্ধ চট্টোপাধ্যায়।

0
639

কলকাতা, নিজস্ব সংবাদদাতা:- “…২০১৯ সালের জন্মদিনের উপহার…আলো আঁধারী পরিবেশে…মাঝরাতে ফোন করেছেন…জিৎ কে নাকানি চোবানি খাওয়ানো ভিলেন…”

২০১৯ সালের ২৪শে মে, রাত তখন সাড়ে বারোটা। প্রায় পাঁচ হাজার স্কোয়ার ফুটের বিশাল অফিস কিউবিকেলে আমি তখন একা। আলো আঁধারী পরিবেশে বসে সঙ্গী ল্যাপটপের সাথে নিস্তব্ধতা উপভোগ করছি। রাত্রি কালীন অফিস যাপন তখন আমার অফিসিয়াল কাজের সাথে সাথে নিজস্ব কাজেরও খোরাক পূরণ করে। বিভিন্ন সিরিজ, ইন্টারভিউ, গল্প পড়া এবং আরও কত কিছু। মনে হয় দিনের ২৪ ঘন্টায় কত কিছু করা যায়। আচমকাই ভাবনার জাল বোনা থমকায় মোবাইলের যান্ত্রিক শব্দে। মাঝরাতে আমায় কল করার মত তো কেউ নেই, তাহলে কি বাড়ির কারও কিছু হলো নাকি। সেকেন্ডের ভগ্নাংশের মধ্যে মাথায় এসব এসে গেল। তাড়াতাড়ি মোবাইলটা চোখের সামনে ধরতেই আমি হতবাক। ঠিক দেখছি তো? আসলে টিভির পর্দায়, সিনেমা হলের বড় পর্দায় যাঁদের দেখে অভ্যস্ত, এতদিন কোনো না কোনো দরকারে তাঁদেরকে আমি কল করে এসেছি, কিন্তু এখানে তো বিষয়টা উল্টো। অর্থাৎ বাংলা ইন্ডাস্ট্রির এক অন্যতম বলিষ্ঠ অভিনেতা মোবাইলের ওপ্রান্তে। একটু ঘাবড়েই গেলাম। এত রাতে কেন? আর তাঁর সাথে তো আমার আলাপ জাস্ট একদিন আগে। দাদার হাসপাতালে আমার মা ভর্তি আর তিনি গেছিলেন তাঁর পরিবারের একজনের চিকিৎসা করাতে। সেখানে আমার দাদা ও মায়ের সাথে আলাপ। তাহলে কি তাঁর আত্মীয়ের শরীর খারাপ আর দাদাকে না পেয়ে আমায় কল করছেন? হেডফোনটা কানে লাগিয়ে ফোন ধরতেই গম্ভীর গলায় বললেন – “ডিস্টার্ব করলাম না তো?” এই প্রশ্নের কি উত্তর দেই। মাঝরাতে ফোন করেছেন নিশ্চই দরকারে, তাতে ডিস্টার্ব হলেও তো কিছুই করার নেই। প্রত্যুত্তরে না শুনে তিনি আবার বললেন, “আসলে ঘুম আসছিলো না, তোমার কাজটা দেখে। আচ্ছা তোমায় কি একটা প্রণাম করতে পারি দেখা হলে?” আমি এরকম প্রস্তাব আগে কোনোদিন পাইনি। একে তিনি বয়সে আমার থেকে প্রায় ১০ বছরের বড়, তার ওপর আমি তাঁর অভিনয়ের ভক্ত সেই কলেজ টাইম থেকে। এভাবে অপ্রস্তুত হবো ভাবতেই পারিনি। ধাতস্থ হয়ে সেই যে কথা চলতে শুরু হলো তা এখনও চলছে। আজ সে অভিনেতার বাইরেও আমার বা আমাদের দাদা, শুভাকাঙ্খী, গাইড, প্রেরণা দাতা। #শ্রীচরণেষুমা আমার জীবনে যেকজন মানুষকে যুক্ত করেছে ইনি তাঁর মধ্যে অন্যতম। অটোগ্রাফ, ইতি মৃণালিনী, অস্কার, ক্রস কানেকশনের মত সিনেমার অভিনেতাও যে আমার কাজের “ফ্যান” হতে পারেন জানা ছিলনা। কার কথা বলছি বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে? আচ্ছা ধরিয়ে দিচ্ছি। “মন দিতে চাই”, “অনুরাগের ছোঁয়া” আর “বাংলা মিডিয়াম” একসাথে এই তিনটে সিরিয়ালে তাঁকে এখন দেখা যাচ্ছে কিংবা সম্প্রতি মুক্তি প্রাপ্ত ফিল্ম #চেঙ্গিজ এ সুপারস্টার জিৎ কে নাকানি চোবানি খাওয়ানো ভিলেন বা বাংলা ইন্ডাস্ট্রির সেই অভিনেতা যাঁর পাশে অনেক নায়কই খাটো (উচ্চতায় তো বটেই, অভিনয়েও) – হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন তাঁর নাম অভ্রজিৎ চক্রবর্তী। বাংলা ইন্ডাস্ট্রির সবার প্রিয় “বাপি”, চেঙ্গিজ এর “ইস্পেহানি” অথবা আর কদিন পর মুক্তি পেতে চলা আমাদের মিউজিক্যাল শর্টস #ভালোআছিভালোথেকো -র “অনির্বাণ”।

আজ তাঁর শুভ জন্মদিন। তাই মনে হল একটু কিছু লিখি তাঁকে নিয়ে, তাঁর কাজ নিয়ে। আসলে আমি যে মানুষদের সান্নিধ্যেই এসেছি সব সময়েই চেয়েছি তাঁদের থেকে ভালো কিছু গ্রহণ করতে আর তার পরিবর্তে এমন কিছু মুহূর্ত ফিরিয়ে দিতে যা তাঁরা সব সময় মনে করতে পারবেন। আর তাই আমি কারোর জন্মদিনে বাহ্যিক গিফট দেওয়া থেকে সরে এসে, তাঁদের নিয়ে বা তাঁদের কে দিয়ে কোনো কাজ করানোর মাধ্যমে তাঁদেরকে কিছু সুন্দর মুহূর্ত উপহার দিতে চেয়েছি। এতে কাজও করা হলো আর পারিশ্রমিকের আঙ্গিকে উপহারও দেওয়া হলো। অনেকেই এই অনুভূতি কে হয়তো উপলব্ধি করতে পারবেন না, বা পারেননি। কিন্তু আমি এভাবেই চলতে থাকবো। আর সেই ভাবেই ২০১৯ সালের জন্মদিনের উপহার স্বরূপ তৈরি হচ্ছে আমাদের পরবর্তী মিউজিক্যাল শর্টস “ভালো আছি, ভালো থেকো”, যেখানে অভ্র দা মুখ্য ভূমিকায়।

২০১৯ সালের ১৪ই জুন আমাদের প্রথম মিউজিক্যাল শর্টস #মৃত্যুর প্রেস কনফারেন্স এ কাকে কাকে আমন্ত্রণ জানাবো সেই নিয়ে যখন প্রচণ্ড রকম টেনশনে তখন কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করেই ফোন করলাম অভ্রদা কে। দিনটা ছিল ১লা জুন। কথায় কথায় জানতে পারলাম দুদিন পর জন্মদিন। কিন্তু কাজের চাপে বেমালুম ভুলে গেলাম। প্রেস মিটে আসার কনফার্মেশন এর জন্য ৬ তারিখ ফোন করতেই বুঝলাম মারাত্মক রকম ভাবে ভুল করে ফেলেছি। আর আমি আরও লজ্জায় পরলাম যখন দাদা বাচ্চাদের মত করে আবদার করে বলল, “কি গিফট দেবে আমায়?” সেদিনই স্থির করেছিলাম পরের কোনো কাজে তাঁকে কাস্ট করেই জন্মদিনের উপহার দেবো তাঁকে। বলিনি তাঁকে। আজ বললাম। মাঝে যখন আমাদের ইন্ডাস্ট্রির মুখুজ্জে দা নতুন ফেলুদার খোঁজ করছিলেন, তখন সেই প্রজেক্ট এর প্রোডিউসার এর সাথে কথা প্রসঙ্গে অভ্র দার নাম বলেছিলাম। যদিও সেই সুপারিশ গ্রাহ্য হয়নি। তবে সেই সুপারিশ গ্রাহ্য হলে হয়তো সেটা হত সবথেকে বড় উপহার। কিন্তু আমি এখনও মনে করি বাংলায় ফেলুদার জন্য অন্যতম সেরা অভিনেতা অভ্রজিত চক্রবর্তী।

এরপর বহু জল বয়ে গেছে নদী দিয়ে। আমি “আপনি” থেকে তুমি তে, আর অভ্র দা “তুমি” থেকে তুই এ উপস্থিত হয়েছে। আমাদের বাবা মা কে নিজের বাবা মা বলে সম্মোধন করা, প্রেস মিটের পর সুন্দর করে বাইট পাঠানো, বহু মানুষকে “শ্রীচরণেষু মা” দেখিয়ে প্রচার করা, অনেক মানুষের সাথে আলাপ করিয়ে কাজের সুযোগ তৈরি করা, আমি হায়দ্রাবাদ থেকে কলকাতায় এলে কফি শপে আড্ডা মারা, কিংবা আমাদের সল্টলেকের ফ্ল্যাটে তাঁর আর এক অভিনেতা বন্ধু যুধাজিৎ দা কে নিয়ে এসে কাজের কথা বলা এসব চলতে চলতেই আচমকা এর মাঝে এসে পড়লো করোনার থাবা। শুরু হলো শিল্পীদের বেঁচে থাকার লড়াই, অনিশ্চয়তা নিয়ে প্রতিদিন ঘুমাতে যাওয়া আর ঘুম থেকে উঠে ভবিষ্যতের প্ল্যান কষা। আমাদের প্রতিদিন না হলেও নিয়মিত যোগাযোগ, মেসেজ, ফোন কল এর মাধ্যমে দুই তরফেই মনের কথা বলে নিজেদের হালকা করার তাগিদ দিনদিন বাড়তেই থাকলো। আর তাই লকডাউন উঠতেই ৩রা সেপ্টেম্বর একবারে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে উপস্থিত হলাম অভ্র দার বাড়ি আমি আর ভাই। গান বাজনা খাওয়া দাওয়া করে রাত সাড়ে দশটায় মনে পড়েছে পরদিন সিরিয়ালের শুটিং ভোরবেলা আর তাতে ছোট চুলে উপস্থিত হতে হবে। কি উপায়! আমি দায়িত্ব নিলাম। কাঁচি আর চিরুনি নিয়ে জীবনে প্রথম বার কারও চুল কাটলাম। তাও কার? খনা সিরিয়ালের মহানামা ক্যারেক্টার বা দুই পৃথিবী সিরিয়ালের রাজনৈতিক দাদার চরিত্রে অভিনয় করা যে মানুষটার অভিনয় দেখে আমি শিখতাম, তার। পরে শুনেছিলাম কন্টিনিউটি ব্রেক তো হয়েইনি, উপরন্তু আসে পাশের অনেকেই নাকি সেই হেয়ার কাটিং এর তারিফ করেছেন। সেই কেশৎপাটনের ভিডিও যদিও পাবলিক করা মানা।

২০২০ থেকে ২১ এর মধ্যে বহুবার অভ্র দার সাথে আড্ডা, গল্প, তর্ক-বিতর্ক, ঝগড়া, মান-অভিমান চলতে চলতে আমাদের কাজের কথাও শুরু হলো। বহু রকম ভাবে হেল্প করতে উঠে পরে লাগলো। যেন নিজেরই হোম প্রোডাকশন। শুটিং লোকেশন ঠিক করে দেওয়া, প্রোডাকশন এ হেল্প করার মানুষ জোগাড় করে দেওয়া, আমাদের সাথে সাথে ঝাঁটা হাতে শুটিং ফ্লোর পরিষ্কার করা, থার্মোকল ধরা, আমি ক্যামেরার সামনে থাকলে টিপস দেওয়া, খাওয়ার পরিবেশন করা, কি না করেছে লোকটা। সব কিছু হয়তো লিখে প্রকাশ করা যাবে না। তাঁর উপযুক্ত পারিশ্রমিক হয়তো তাঁকে দিতে পারিনি, আমাদের সাধ্য মত দেবার চেষ্টা করেছি। কিন্তু কাজটা ভালো করে শেষ করে সেই ব্যর্থতা পুষিয়ে দিতে চাই। কমার্শিয়াল সিনেমার হার্ডকোর ভিলেনও যে ভালোবাসার অভিনয় করতে পারে মানুষকে জানাতে হবে তো।

কদিন আগেই মুক্তি পেয়েছে চেঙ্গিজ। বহু দিন বাদে জিৎ এর বাংলা কমার্শিয়াল ছবি। তার সাথে যুক্ত হল প্যান ইন্ডিয়া রিলিজ। ছবিটার শুটিং শুরুর আগে থেকেই অভ্র দার মুখে সমস্ত গল্প শুনতে শুনতে কখন যেন আমিও ওই সিনেমার একজন হয়ে উঠেছিলাম। আর তাই বাবা মার বিবাহ বার্ষিকীর দিন অর্থাৎ ২৭শে এপ্রিল স্বপরিবারে উপস্থিত হলাম আমাদের পরিবারের আরেক ছেলের (এই পরিচয় টাই অভ্র দা দিতে পছন্দ করে বেশি) অভিনয় দেখতে। আমি সিনেমার ভালো মন্দ গুন বিচার করতে যাবো না, কিন্তু একটা জিনিস খুব ভালো ভাবে বুঝেছি এই ইন্ডাস্ট্রি অভ্রজিৎ চক্রবর্তী কে অবহেলা করে ভুল করছে বা করেছে। এই অভিনেতার আরও বেশি কাজ করা উচিৎ যাতে আমাদের মতন নতুনরা উদ্বুদ্ধ হতে পারে। চেঙ্গিজ এর ইস্পেহানি আরও বেশি কাজ, আরও বৈচিত্র্যময় ক্যারেক্টার, আরও বেশি স্ক্রীন প্রেজেন্স দাবী করে। জিৎ এর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ভিলেন হয়ে সামান্য হলেও আলো নিজের দিকে রাখতে পারার জন্য দম লাগে। সেখানে এখানে সমানে সমানে টক্কর দিয়ে গেছে। সিনেমার শেষের দিকে স্কুটার এর সামনে দাঁড়িয়ে বউ এর সাথে ঝগড়া এবং সেখান থেকে মানসিক পট পরিবর্তন এর দৃশ্য, সেটা সবার পক্ষে করা সম্ভব নয়। রোহিত রায়, শতাফ ফিগার দের উপস্থিতিতেও নিজের জাত চেনানোর জন্য যোগ্যতা লাগে। আর সেটা আমার “অনির্বাণ” এর ভরপুর আছে। শুধু মাত্র ফেসিয়াল এক্সপ্রেশনেই অনেক কিছু বোঝানোর যে অধ্যাবসায় সেটা হয়তো বাংলা সিরিয়াল এর ভালো দিক।

চেঙ্গিজ নিয়ে কিছু না লেখার জন্য দাদার মনে অনেক অভিমান ছিল জানি। তাই আজ রাত জেগে এই লেখার অবতারণা। কারণ আমি জন্মদিনের ভোরবেলা এই সারপ্রাইজটা দিতে চেয়েছিলাম। অভ্র দা, অনেক অনেক শুভেচ্ছা, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা। শুনেছি জন্মদিনের দিন ভগবানের কাছে কিছু চাইলে সেটা পাওয়া যায়, তাই তোমায় অনুরোধ আমার জন্য বা আমাদের জন্য একটু প্রার্থণা কোরো যাতে পেট চালানোর তাগিদ রক্ষা করতে মনের খোরাক বন্ধ না হয়ে যায়। সৃষ্টির সাথে যেন থাকতে পারি। শুভ জন্মদিন দাদা। আর কদিন পর আমরা আসছি একসাথে। ততদিন “ভালো আছি ভালো থেকো”।

Avrajit Chakraborty | Rinika Saha | Sampurna Chakraborty | Chandan Das | Arindam Chattopadhyay

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here