দামাল মেয়ে কুহেলি (ধারাবাহিক উপন্যাস, ত্রয়োদশ পর্ব) : দিলীপ রায়।

0
355
   নীলকন্ঠ উদ্বিগ্ন । থানা থেকে বাড়ি ফেরেনি জগন্নাথ । বাড়ি ফিরতে সাধারণত ছেলেটা  এত রাত্রি করে না । দুশ্চিন্তায় নীলকন্ঠ অস্থির । দোকান বন্ধ করে আমলাই বাজার  থেকে অনেকক্ষণ আগে বাড়ি ফিরেছে নীলকন্ঠ । বাড়ি এসে দেখে ছেলেটা বাড়ি ফেরেনি । সাধারণত রাত্রের খাবার তারা তিনজন একসঙ্গে  খায় । ছেলেটা না ফেরায় তারা খেতে বসতে পারছে না । তাই নীলকন্ঠের অস্থিরতা । অস্থিরভাবে নীলকন্ঠ  একবার ঘরে, আর একবার বাইরে করছে  । রাত্রি অনেক । চারিদিকে অন্ধকার । গাঁয়ের রাস্তা সুনসান !  
   হঠাৎ রাস্তা দিয়ে দুটো মোটর বাইক তার দিকে ধেয়ে আসছে । সাহাপুরের মানুষ সহজ সরল । খাটাখাটুনিতে তাঁদের জীবন যাপন । খুব প্রয়োজন না থাকলে এত রাত্রিতে কেউ বাড়ির বাইরে বের হয় না । মনে হচ্ছে কোনো বিপদের সংকেত ! নতুবা দুটি লোক সজোরে বাইক চালিয়ে তার দিকে ধেয়ে  আসবে কেন ? 
    বাইক থেকে নেমে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো, “আমি কাঞ্চন নগরের শ্যামল । আপনি আমাদের চিনবেন না । আপনার ছেলে জগন্নাথ কুহেলিকে খুঁজতে অনেক দূর চলে গেছে ।“
    তাকে খুঁজতে কোথায় গেছে ?  সেটা বলবেন তো ?
    কোথায় গেছে আমরা কিচ্ছু জানি না । 
    কী হয়েছিল সেটা বলবেন তো  ? তা ছাড়া কুহেলি কে ? 
    “সন্ধ্যা রাত্রিতে কাঞ্চন নগরের মোড় থেকে তিনজন দুষ্কৃতি কুহেলি ও পুবালীকে চার চাকার গাড়িতে তুলে উধাও । ঠিক পরক্ষণেই জগন্নাথ কুহেলির চায়ের দোকানে হাজির । কাঞ্চন নগরের মোড়ে কুহেলির চায়ের দোকান । ভীষণ চালু দোকান !  জগন্নাথ কুহেলিকে ভীষণ ভালবাসে । তাই জগন্নাথ ক্রোধে অগ্নিশর্মা । যেভাবে হোক কুহেলিকে উদ্ধার করতে হবে । জগন্নাথের সন্দেহ, এই নিন্দনীয় জঘন্য কাজটি  নারী পাচারকারী দলের । প্রায় সঙ্গে সঙ্গে মোটর বাইকে আমাকে তুলে নিয়ে থানায়  । থানার গাড়িতে  মাত্র দুজন পুলিশ সঙ্গে  নিয়ে জগন্নাথ কোথায় ছুটলো আমাকে বলে যায়নি । শুধুমাত্র আমাকে বলে গেলো, বাইকটা বাড়িতে পৌঁছে দিতে এবং আপনাকে খবর দিতে ।“ এইটুকু বলে শ্যামল আবার বললো, “আমার ধারণা কুহেলিকে উদ্ধার না করে জগন্নাথ বাড়ি ফিরবে না ।“
      নীলকন্ঠের মাথায় হাত ! তার ছেলের  সদ্য  চাকরি । দুর্বৃত্তদের সাথে তার এখনও এ্যাকশনের  অভিজ্ঞতা  নেই । তাই দুর্বৃত্তদের সাথে সে কতোটা এঁটে ওঠবে সেই চিন্তায় নীলকন্ঠ অস্থির । নারী পাচারকারীরা খুব ভয়ংকর । তারা তাদের স্বার্থে বাপ-ভাই-বোন কাউকে রেয়াত করে  না । সুতরাং তিনজন পুলিশকে দুষ্কৃতিরা কখনই সহজে ছেড়ে দেবে না । জগন্নাথের মা শুনলে, তাকে কীভাবে বোঝাবে ? সেটাও আর একটা বড় চিন্তা ! 
    শ্যামল বাইকটি ফেরত দিয়ে তার বন্ধুর বাইকে ঘরে ফিরে গেলো ।    
    নীলকন্ঠ ঘরে গিয়ে অনেকক্ষণ মাথায় হাত দিয়ে চুপচাপ বসে রইলো । অন্যদিকে ছেলের  ফিরতে  দেরী হচ্ছে দেখে  গিন্নি ঘরে গিয়ে বিছানায় শুয়ে ঘুমোচ্ছে । নীলকন্ঠ গিন্নিকে আর ডাকলো না । ছেলের খবর জানতে পারলে গিন্নি প্রচণ্ড উতলা হয়ে উঠবে । তখন নাছোড়বান্দা হয়ে মালদাতে ছুটতে চাইবে । সেটাও আবার  একটা জ্বালা ! নীলকন্ঠ কস্মিনকালেও শুনেনি এমনকি ভাবেনি, জগন্নাথ কুহেলিকে ভালবাসে । রাস্তার উপরে চায়ের দোকানের মেয়েকে জগন্নাথ কীভাবে এতখানি ভালবাসলো, এটাও  তাঁর মোটা মাথায় কিছুতেই ঢুকছে না । ছেলেটা বড় হয়েছে, বুঝতে শিখেছে, এবার নীলকন্ঠ বুঝতে পারছে । কেননা ছেলের একটা  নিজস্ব মত তৈরী হয়েছে । যার উপর ভিত্তি করে ইতিমধ্যে একটা মেয়েকে ভালবেসে ফেললো । ছেলের ভালবাসা যে গভীর সে বিষয়ে নীলকন্ঠ নিশ্চিত ! নতুবা তাকে বাঁচানোর জন্য এতটা ঝাঁপিয়ে পড়তো না । কুহেলিকে উদ্ধারের জন্য ছেলের কাণ্ডকারখানা দেখে নীলকন্ঠের  চিন্তা আরও বেড়ে গেলো । অন্যদিকে ছেলেটার সাথে সাথে তার প্রিয় বান্ধবী কুহেলির জন্যেও নীলকন্ঠের চিন্তা শুরু হলো  । ঘরে  বসে বসে  ঝিমোচ্ছে নীলকন্ঠ ।   হঠাৎ জগন্নাথের ফোন, “বাবা, আমার জন্য দুশ্চিন্তা করো না । কুহেলিকে উদ্ধার করে আমি তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরছি । ইতিমধ্যে আমরা মালদা পৌঁছে গেছি । মালদার জেলা পুলিশ প্রশাসন আমাদের টীমকে যথেষ্ট সহায়তা করছেন । সুতরাং বিপদের ভয় নেই ।  কিন্তু আমাকে ফোন করে বিরক্ত করো না । প্রয়োজন হলে আমি ফোন করে সর্বশেষ পরিস্থিতি  তোমাদের  জানিয়ে দেবো ।“   
    বোলারো গাড়ির নম্বর পেয়ে সমস্ত থানায় জানিয়ে দিলো । থানার অধীনে  সড়কের সমস্ত পুলিশ পিকেটংয়ে  খবর পৌঁছে গেলো ।  পুলিশের মধ্যে যোগাযোগের দায়িত্বে জগন্নাথ । মালদা থেকে জগন্নাথ খবর পেলো, দুষ্কৃতিদের গাড়ি শিলিগুড়ির দিকে না গিয়ে রায়গঞ্জের দিকে ধাবিত । তাই পুলিশের অনুমান, দুষ্কৃতিরা বর্ডার পার হয়ে বাংলাদেশে পালাতে পারে । সঙ্গে সঙ্গে মালদা থেকে বালুরঘাটের পুলিশ পিকেটিংকে  জানিয়ে দিলো  । কেননা বালুরঘাট দিয়ে হিলি বর্ডার যাওয়ার রাস্তা । হিলি বর্ডার পার হলেই বাংলাদেশ । বাংলাদেশের দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, রংপুর, ইত্যাদি জেলা । পাশেই এ্যায়ারপোর্ট । সুতরাং পুলিশের ধারণা, বাগডোগরা বিমান বন্দরে না ঢুকে বাংলাদেশে পালিয়ে যেতে পারে । ইচ্ছা করলে,  দুষ্কৃতিরা খুব সহজে  অসাধ্য সাধন করতে পারে । 
     দুষ্কৃতিদের গাড়িতে বিভিন্ন নামী-দামী ব্রাণ্ডের ফরেন লিকারের বোতল । ফরাক্কা ব্যারেজ পার হওয়ার পর এবং ঠিক মালদা ঢোকার মুখে চারজনে মদ খেয়ে নেশায় বুঁদ । নেশার ঘোরে চারজনের চোখ ঢুলু ঢুলু ।  হঠাৎ ফোন আসায় দুষ্কৃতিরা নড়েচড়ে বসলো । তাদের টার্গেট ছিলো  শিলিগুড়ি  ! তারপর বাগডোগরা বিমান বন্দর থেকে অন্য টিমের সাথে একত্রে অন্যত্র পলায়ন ।  কিন্তু তারা সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে হিলি বর্ডার দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো । তাদের কথোপকথনে কুহেলির এটা অনুমান ।          
        রায়গঞ্জ পার হয়ে বোলারো গাড়িটা জঙ্গল ঘেঁষা রাস্তার পাশে থামলো । কুহেলিদের চোখ ও মুখ খোলা । শুধুমাত্র হাত বাধা । কুহেলি দেখতে পেলো কিছুটা দূরে একটা ছোটখাটো ধাবা । সেখানে টিমটিম করে আলো জ্বলছে । একজন দুষ্কৃতিকে গাড়িতে পাহাড়ায় রেখে অন্য তিনজন ধাবায়  ছুটলো । হয়তো তাদের লোক সেখানে অপেক্ষা করছে । নতুবা অন্য কারণে ধাবায় যেতে পারে । কারণটা কুহেলির বোধগম্য হলো না । তবে বুঝতে পারলো এখানে তারা কিছুক্ষণ দাঁড়াবে । যাওয়ার সময় একজন বয়স্ক দুষ্কৃতিকে পাহাড়ায় রেখে  বলে গেলো, মেয়ে দুটির উপর সর্বক্ষণ  নজর রাখতে  ।
      যাকে বসিয়ে গেছে সে অনেক বয়স্ক । তার উপর অতিরিক্ত ড্রিঙ্ক করার ফলে বাছাধন  স্বাভাবিক অবস্থায় নেই । মদ্য অবস্থায় ফ্যাল ফ্যাল করে যুবতী দুটি মেয়ের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলো  পঞ্চাশোর্ধ পাহাড়াদার । কুহেলি চালাক মেয়ে । তেমনি শারীরিকভাবে শক্ত সামর্থ ।  এই সময়টাকে কাজে লাগাতে চাইছে  ।  কুহেলি মনে মনে মতলব আঁটলো, এই সুযোগে এখান থেকে পালাতে হবে । পাহাড়াদার দুষ্কৃতিকে কীভাবে পটানো যায় তার ফন্দি আঁটতে শুরু করলো । সময় কম । যা করতে হবে খুব দ্রুত করতে হবে এবং খুব সাবধানে । ধরা পড়লে হবে না ।  কোনো কারণে অন্য  তিজনের নজরে এলে ঘোরতর বিপদ ! তাই খুব সন্তর্পণে তাকে অনুসরন করতে পুবালীকে ইশারা করলো । বাঁকা চোখের ইশারায় পাহাড়াদারের দৃষ্টি আকর্ষণ করলো । হাত বাঁধা । তাই হাত দিয়ে কিছুই বোঝাতে পারলো না । কুহেলি পাহাড়াদারকে অঙ্গভঙ্গি করে ন্যাকামি সুরে  বললো, “তুমি দূরে কেন ? আমাদের মাঝখানে এসে বসো । তোমার সুরসুরি পেলে আমরা খুব মজা পাবো ।“ পুবালী আরও বেশীমাত্রায় অঙ্গভঙ্গি করে আড় চোখে পাহাড়াদারকে ইশারায় বললো, “ডার্লিং, আমার পিঠটা খুব চুলকাচ্ছে । তুমি একটু পিঠটা চুলকিয়ে দাও না !” 
   যুবতী মেয়েদের রসাত্মক আবেদনে সাড়া দিলো পাহাড়াদার দুষ্কৃতি  । পকেটের পিস্তল সিটের উপর নামিয়ে রেখে  প্রথমেই পুবালীর কাছে গিয়ে তার পিঠ চুলকাতে উদ্যত হলো । তৎক্ষণাত পুবালী অঙ্গভঙ্গিমা করে বললো, “উঁহু ডার্লিং, হাতটা না খুললে আমরা তোমাকে আদর করবো কীভাবে ?” কুহেলি আরও একটু এগিয়ে ন্যাকামী সুরে বললো, “তুমি আমাদের নাগর । নাগরের সাথে মজা করতে হলে হাত বাঁধা থাকলে কীভাবে হবে ? হাতটা খুলে দিয়ে আমাদের পাশে বসো ।” 
    পাহাড়াদার দুষ্কৃতি পুবালীর দিকে তাকিয়ে বললো, “হাত খোলার হুকুম নেই ।“
    “আরে ডার্লিং, মজা হয়ে গেলে পুনরায় হাত বেঁধে দেবে ।“  পুবালী ঢঙ করে আবদার করলো । তাতেই পাহাড়াদার দুষ্কৃতি  পটে গেলো,  “ঠিক আছে,  আমি হাত খুলে দিচ্ছি । তার আগে তোমাদের পিঠটা একটু চুলকিয়ে দিই ।“ 
      পাহাড়াদার দুষ্কৃতির  তখন ভাববার সময় নেই । যুবতী মেয়েদের সাথে মজা-মস্করা করার এত বড় সুযোগ সে কিছুতেই হাতছাড়া করতে চাইছে না । পুবালী ও কুহেলির যৌন আবেদন অবলোকন করে পাহাড়াদার দুষ্কৃতি আনন্দে উত্তেজিত ।   হাতের দড়ি খুলে দিয়েই পুবালীকে নিয়ে টানাটানি । ততক্ষণে কুহেলি পিস্তল  সোজা পাহাড়াদার দুষ্কৃতির কপালে ঠেকিয়ে বললো, “বাঁচতে চাইলে সোজা হয়ে দাঁড়া । নতুবা এখানেই শেষ ।“  
   পাহাড়াদার দুষ্কৃতি এখন  অন্য নেশায় উত্তেজিত ! মজার উচ্ছ্বাসে বিভোর । কিছুতেই পুবালীকে ছাড়ছে না । জাপটে ধরে বলছে, “একটু মজা করে নিই ডার্লিং ।“ 
    কুহেলি কনুই দিয়ে তার ঘাড়ে জোরে আঘাত করায় গাড়ির ভিতর পড়ে গেলো । পুবালী তখন তড়িঘড়ি দড়ি দিয়ে পাহাড়াদার দুষ্কৃতির হাত-পা বেঁধে ফেললো । অন্যদিকে কুহেলি কাপড়ের টুকরো দিয়ে চোখ ও মুখ বেঁধে দিয়ে বললো, “তুই শুয়ে থাক । এবার আমরা চললাম !”
     খুঁজে খুঁজে তাদের মোবাইল ও দুষ্কৃতির  পিস্তলটা নিয়ে চম্পট ! পিস্তল সাথে রাখার একটাই কারণ, অন্তত প্রয়োজনে আত্মরক্ষার জন্য কাজে লাগতে পারে । 
       রাত্রি অনেক । তবে ভোর হতে অনেকটা দেরী । পিছন দিক দিয়ে তারা জঙ্গলে ঢুকে প্রথমেই জগন্নাথকে ফোন । জগন্নাথ ফোন পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে রায়গঞ্জ থানাকে জানিয়ে দিলো । থানার পুলিশ ঝটাপট স্পটে হাজির । কেননা দুষ্কৃতিদের  গাড়ি রায়গঞ্জ শহর ছাড়িয়ে একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিলো । ফলে অল্প সময়ের মধ্যে রায়গঞ্জ থানার পুলিশ পৌঁছে গেলো ।  জগন্নাথ আগেই জানিয়ে রেখেছিলো, দুষ্কৃতিরা ধাবায় ঢুকেছে । তাই দ্বিতীয় পুলিশের গাড়িটা সোজা ধাবায় ।  আশ্চর্যের ব্যাপার ধাবায় এসে দেখে ধাবায় কেউ নেই । এমনকি ধাবার মালিক পর্যন্ত নেই । পুলিশের অনুমান, পুলিশ আসার খবর অগ্রিম কেউ জানিয়ে দেওয়ায় দুষ্কৃতিরা পালিয়েছে ।“ 
     ধরা পড়লো পাহাড়াদার দুষ্কৃতি । তার হাত-পা এমনকি চোখ-মুখ বাঁধা । ইচ্ছে থাকলেও  তার পালাবার উপায় নেই । অবশেষে রায়গঞ্জ থানার  পুলিশের কাছে একজন দুষ্কৃতি ধরা পড়লো । তবুও রায়গঞ্জ থানার পুলিশের  স্বস্তি, একজন দুষ্কৃতি অন্তত ধরা পড়েছে ।  জিজ্ঞাসাবাদ করে অনেক তথ্য পুলিশ পাবে । 
      কুহেলিকে জগন্নাথ বলেছিলো, তোমরা বেশীদূরে যাবে না । কেননা রায়গঞ্জের পুলিশ তোমাদের উদ্ধার করে সসম্মানে বাড়ি  ফিরিয়ে দেবে । 
        কিন্তু জঙ্গলে তাদের কাছাকাছি মানুষের পায়ের একটা খটমট আওয়াজ পেয়ে কুহেলি ঝুঁকি নিলো না । কিছুদূর হাঁটার পর তাদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলো । এতক্ষণ জগন্নাথের কথামতো রায়গঞ্জ যাওয়ার সিদ্ধান্তে অবিচল ছিলো । কিন্তু মানুষের পায়ের খটমট আওয়াজে কুহেলি ভাবলো, দুর্বৃত্তরা পুনরায় আক্রমণ করলে নিজেদের বাঁচানো কঠিন হয়ে দাঁড়াবে ।  যদিও রাত্রি শেষ হওয়ার দিকে । তবুও ঘন অন্ধকার রয়েছে । জমিতে তখনও বড় বড় পাট রয়েছে । কিছু জমিতে পাট কাটা হয়ে গেছে ।  পাটের জমির ভিতর দুষ্কৃতিরা ঘাপটি মেরে বসে থাকলে কুহেলিরা কিচ্ছু  টের পাবে না । তার চেয়ে বরং উল্টোদিকে যাওয়া তাদের নিরাপদ । রাতের অন্ধকারে জমির আইল দিয়ে পুবালী ও কুহেলি ছুটছে ।  কোথায় যাচ্ছে নিজেরাই জানে না । শুধু তারা বড় রাস্তার অপেক্ষায় । বড় রাস্তা পেলে নিরাপদে কোথাও আশ্রয় নেওয়া যাবে ।  হঠাৎ পিস্তলের গুলির শব্দ । ঠিক তাদের কাছ থেকে । কুহেলির ধারণা, দুষ্কৃতিরা তাদের পিছু ধাওয়া করেছে । সামনেই একটা জলাশয় । জলাশয়ের কিনারে জাঁক দেওয়া পাট ছাড়ানোর পর শুকানোর জন্য পাটকাঠি দাঁড় করানো ।  গাঁয়ের মেয়ে কুহেলি । সে জানে, পাট ছাড়ানোর পর কীভাবে পাটকাঠি দাঁড় করিয়ে রাখতে হয় । পাটকাঠি দাঁড় করালে মাঝখানটা ফাঁকা থাকে । তাই তারা সাতপাঁচ না ভেবে সোজা দাঁড় করানো পাটকাঠির মাঝখানে ঢুকে গেলো । সেখানে ঢুকে তারা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো । অন্তত দুষ্কৃতিরা তাদের টিকিও  ছুঁতে পারবে না । ভোর হলে এখান থেকে বের হবে । 
     জলাশয়কে দীঘি বলা যেতে পারে । বিশাল বড় দীঘি । দীঘির কিনারে এখনও পাটের জাঁক রয়েছে । অন্ধকারে মাঠের ফসল বোঝা যাচ্ছে না । তবে এলাকাটা কৃষি এলাকা, জমি-জায়গা দেখে এটা বোঝা যায় । কুহেলি অন্তত নিশ্চিত, তাদের দুষ্কৃতিরা নাগাল  পাবে না ।   পাটকাঠির ফাঁক দিয়ে দুজনে দেখলো, চার জন দুষ্কৃতি জলাশয়ের পাশের রাস্তা দিয়ে ছুটছে । তাদের চোখ শ্যেন দৃষ্টির ন্যায় ।  চতুর্দিকে তাকাতে তাকাতে  যাচ্ছে । কুহেলি ও পুবালীকে হারিয়ে তারা এখন ওদের ধরার জন্য মরিয়া । কুহেলি দুষ্কৃতিদের হেঁটে যাওয়ার পরিস্থিতি দেখে বুঝতে পারলো, তারা পুলিশি অভিযানের ভয়ে একটুও  ভীত নয় । যাই হোক  চুপচাপ  দুজন পাটকাঠির মধ্যে ঘাপটি মেরে বসে রইলো । কোনোরকম শব্দ করার উপায় নেই । ফোন করা তো দূরের কথা । এখন তাদের মাথায় একটাই চিন্তা, ভোর হলেই এখান থেকে পালানো ।     
      কিছুটা গিয়ে দুষ্কৃতিরা দীঘির পাড়ে বসলো । বিড়ি খাচ্ছে । 
      মহা ফাঁপড়ে পড়লো কুহেলি ও পুবালী । দুষ্কৃতিদের জন্য তারা টু শব্দ পর্যন্ত করতে পারছে না । নড়াচড়া করার উপায় নেই,  অথচ পালাতে চাইলে হবে না । দুষ্কৃতিরা আর একবার  ধরলে  বাঁচার পথ বন্ধ ।  ভয়ে, আতঙ্কে পুবালী  ও কুহেলির মুখ শুকিয়ে কাঠ । দুজনে ভীষণ বিপদ্‌গ্রস্ত । মানসিকভাবে বিপর্যস্ত । তাদের দুর্গতির শেষ নেই । কীভাবে তারা নিজেদের বাঁচিয়ে বাড়ি ফিরবে সেই টেনশনে তারা ঘামছে । চোখে মুখে আতঙ্কের ছাপ ! বাঁচার জন্য চোখ বুজে পুবালী  ইষ্টনাম জপ শুরু করে দিলো ।  কুহেলি খুব সাহসী মেয়ে । সহজে কাহিল হওয়ার মেয়ে নয় । যে কোনো প্রতিকুল  অবস্থার মোকাবিলা করতে  কুহেলি সিদ্ধহস্ত । তাই সে একটুও না ঘাবড়িয়ে পুরো অবস্থাটার উপর নজর রাখছে । 
     ধীরে ধীরে পূর্ব আকাশে রক্তিম আভা প্রস্ফুটিত হচ্ছে । তাতেই কুহেলির ধারণা, কিছুক্ষণের মধ্যে আকাশে সূর্যের উদয় ঘটবে । পরিষ্কার আকাশ । তাই কুহেলির আশা, দিনের ঝলমলে রৌদ্র ওঠার সম্ভাবনা উজ্জ্বল ।   
                                                                                       (চলবে)