![]()
মেঘালয়, যার নামের অর্থই হলো “মেঘের আবাস”, প্রকৃতির বুকে এক অনন্য বিস্ময়ভূমি। পাহাড়, নদী, জলপ্রপাত, কুয়াশা আর গানের মতো বয়ে যাওয়া বাতাসে মেঘালয় যেন এক জীবন্ত কবিতা। এই কবিতার অন্তরে লুকিয়ে আছে অসংখ্য রহস্যময় গুহা — আর তাদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো লাইটখল গুহা (Liatkhwl Caves)। এই গুহা প্রকৃতিপ্রেমী ও অভিযাত্রীদের জন্য এক অতুলনীয় অভিজ্ঞতার দুনিয়া।
লাইটখল গুহার অবস্থান ও পরিচয়
লাইটখল গুহা অবস্থিত মেঘালয়ের পূর্ব জয়ন্তিয়া পাহাড় জেলায় (East Jaintia Hills), থলিয়ং ও লুমশং গ্রামের কাছাকাছি। শিলং থেকে প্রায় ১৩০ কিলোমিটার দূরে এই গুহার অবস্থান। মেঘালয়ের অনেক গুহার মতোই এটি চুনাপাথরের (limestone) গঠিত — এবং এখানকার গুহা গুলি ভারতের মধ্যে সবচেয়ে দীর্ঘ ও রহস্যময় গুহাগুলির মধ্যে অন্যতম।
‘লাইটখল’ শব্দটি স্থানীয় জয়ন্তিয়া ভাষা থেকে এসেছে, যার অর্থ “পাহাড়ের নিচের পথ”। সত্যিই, এই গুহার ভেতর দিয়ে চলা মানে যেন পৃথিবীর নিচের এক গোপন জগতে প্রবেশ করা।
প্রকৃতির হাতে গড়া এক শিল্পকর্ম
লাইটখল গুহায় প্রবেশ করলে মনে হয় যেন অন্য এক জগতে চলে এসেছি। গুহার ভিতরে অদ্ভুত আকৃতির স্ট্যালাকটাইট (stalactite) ও স্ট্যালাগমাইট (stalagmite) গঠন যেন প্রকৃতির এক শিল্পের বিস্ময়। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে জলবিন্দুর ক্ষয়প্রক্রিয়ায় এই গুহার দেয়ালে তৈরি হয়েছে পাথরের ঝুলন্ত নকশা, যা দেখতে একেবারে দেবালয়ের মতো।
গুহার ভেতরকার কিছু অংশ এতটাই সরু যে, হাঁটু গেড়ে বা হামাগুড়ি দিয়ে যেতে হয়। আবার কিছু অংশ বিশাল প্রাঙ্গণের মতো প্রশস্ত, যেখানে প্রতিধ্বনি শোনা যায় নিজের নিঃশ্বাসের।
আলো-অন্ধকারের জাদু
গুহার ভেতরে আলো আর অন্ধকারের খেলাই এর সবচেয়ে বড় আকর্ষণ। টর্চলাইটের আলোয় যখন পাথরের দেয়ালে নকশাগুলি ঝলমল করে ওঠে, মনে হয় যেন কোনো প্রাচীন সভ্যতার ধ্বংসাবশেষের ভেতর ঘুরে বেড়াচ্ছি। জলবিন্দুর টুপটাপ শব্দ, ঠান্ডা বাতাস, আর মাটির গন্ধ—সব মিলিয়ে এক অনন্য পরিবেশ সৃষ্টি হয়, যা শুধু অনুভব করা যায়, বর্ণনা করা যায় না।
লাইটখল গুহার জীববৈচিত্র্য
এই গুহা শুধু ভূতাত্ত্বিক বিস্ময় নয়, এটি জীববৈচিত্র্যের এক আশ্রয়স্থল। এখানে বিভিন্ন প্রজাতির বাদুড়, পতঙ্গ ও বিরল গুহা-বাসী প্রাণী দেখা যায়। বিজ্ঞানীদের মতে, গুহার কিছু অংশে এমন জীবাণু ও ক্ষুদ্রজীব বাস করে যেগুলি পৃথিবীর অন্য কোথাও পাওয়া যায় না।
অভিযাত্রীদের জন্য এক রোমাঞ্চকর গন্তব্য
যারা স্পেলাঙ্কিং (Cave Exploration) বা গুহা অভিযানে আগ্রহী, তাদের জন্য লাইটখল গুহা এক স্বপ্নের জায়গা। স্থানীয় গাইডদের সঙ্গে নিরাপদে এই গুহা ঘোরা যায়। অনেক সময় দড়ি, হেলমেট, ও টর্চের সাহায্যে গুহার গভীর অংশে নামতে হয় — যা রোমাঞ্চপ্রিয়দের কাছে জীবনের এক স্মরণীয় অভিজ্ঞতা।
গুহার অভ্যন্তরে কখনও কখনও স্বচ্ছ জলের ধারা প্রবাহিত হয়, আবার কিছু অংশে দেখা যায় অদ্ভুত পাথরের স্তম্ভ, যা সূর্যের আলো না পেলেও নিজস্ব সৌন্দর্যে দীপ্ত।
গুহার চারপাশের প্রকৃতি
লাইটখল গুহার চারপাশে পাহাড়ি গ্রামগুলির মনোরম পরিবেশ রয়েছে। জয়ন্তিয়া পাহাড়ের ঢালে গড়ে ওঠা এই অঞ্চল সবুজ বন, ঝর্ণা ও কুয়াশায় আচ্ছন্ন। সকালে পাখির ডাক, আর সন্ধ্যায় মেঘে ঢাকা আকাশ—এখানে প্রতিটি মুহূর্তই যেন এক কবিতার লাইন।
গ্রামবাসীরা অত্যন্ত আন্তরিক এবং পর্যটকদের স্বাগত জানাতে সর্বদা প্রস্তুত। তারা গুহার ইতিহাস ও কিংবদন্তি নিয়ে গল্প শোনাতে ভালোবাসে—যেন পাহাড়ের বুকে লুকিয়ে থাকা রহস্যের কণ্ঠস্বর।
️ ভ্রমণের প্রস্তুতি ও টিপস
- গুহা অভিযানের আগে স্থানীয় গাইড নেওয়া আবশ্যক।
- সঙ্গে নিন হেডল্যাম্প, জুতো, জলরোধী পোশাক ও পানীয় জল।
- ভিতরে ফটোগ্রাফি করতে চাইলে ওয়াটারপ্রুফ ক্যামেরা ব্যবহার করুন।
- বর্ষাকালে গুহার ভেতর জল জমে যেতে পারে, তাই অক্টোবর থেকে এপ্রিল সময়টা ভ্রমণের জন্য সবচেয়ে ভালো।
উপসংহার
মেঘালয়ের লাইটখল গুহা শুধুমাত্র একটি পর্যটন কেন্দ্র নয়, এটি প্রকৃতির অন্তরে এক রহস্যের দরজা। এখানে এসে আপনি বুঝবেন—পৃথিবী শুধু উপরে নয়, নিচেও কতটা সুন্দর, কতটা গভীর।
গুহার অন্ধকারে দাঁড়িয়ে যখন এক ফোঁটা আলো আপনার মুখে পড়ে, তখন মনে হয় আপনি যেন নিজের অস্তিত্বের গভীরে পৌঁছে গেছেন। প্রকৃতি এখানে নিঃশব্দে শেখায়—নিরবতাও এক ধরনের সংগীত।












Leave a Reply