‘ ম্যায় জিন্দা হু লেকিন কাঁহা জিন্দেগী হ্যায় / মেরি জিন্দেগী তু কাঁহা খো গ্যায়ি হ্যায় ‘ বৈশাখের প্রথম কালবৈশাখী নেমেছে ধরিত্রীর বুকে…. তীব্র ঝড়ে উড়ে যায় শুকনো পাতা, আবর্জনা | বড় সুন্দর, বড় ভয়ঙ্কর সে ঝড়, জানালায় বসে গরম কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে পছন্দের গান শোনার আমেজই আলাদা | এদিকে ঝড় উঠেছে মনের ঘরেও | বাইরে ঝড় থামল, আকাশ থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় বৃষ্টি নামল | তবে মাটির সোঁদা গন্ধ এই কংক্রিটের শহরে আসে না | মাটির টান হারিয়ে গেছে চোরাবালিতে, শিকড় উপড়ে ফেলা গাছের মতই চার দেওয়ালের খাঁচার ভিতর বন্দী জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে বেঁচে থাকা, ভালো থাকার জন্য নয় শুধুই বেঁচে থাকার জন্য ! কীরে, খেতে আসবি না? তুমি কখন এলে? এইতো সবে ডুপ্লিকেট চাবিটা দিয়ে ফ্ল্যাটের দরজা খুলে ঢুকলাম | ঢুকে দেখি ঘর অন্ধকার, কি করছিলি তুই ? আমি আলো জ্বালালাম অার তুই টেরও পেলি না | যাইহোক, তোর পছন্দের চাইনিজ এনেছি টেক অ্যাওয়ে কাউন্টার থেকে, তুই চট করে হাত ধুয়ে আয় আমি প্লেট সাজাচ্ছি | ভেবেছিলাম আজ মা-মেয়েতে মিলে চাউম্যানে খেতে যাব কিন্তু যা ঝড়- বৃষ্টি, তাই প্যাক করিয়ে বাড়িতেই নিয়ে চলে এলাম | দুজনে মিলে জমিয়ে গল্প করতে করতে খাওয়া যাবে | আচ্ছা, যাচ্ছি যাচ্ছি…. বলে বাথরুমের লাগোয়া বেসিনে হাত ধুতে চলে গেল ঋত্বিকা | সদ্যই ব্রেকআপ হয়েছে ওর, মন খুব খারাপ | তবে চাইনিজ এসেছে শুনে মনখারাপটা একটু একটু করে কাটছে যেন | আসলে কলেজের এই টিনএজ প্রেমগুলো বেশ সুন্দর হয়, অনেকটা বাচ্চা বাচ্চা টাইপ | একটুতেই রাগ আবার একটুতেই তুই আমার শিরায় শিরায় বিষ…… |
ঋত্বিকার সঙ্গে সপ্তকের আলাপটা স্কুললাইফ থেকেই | এক কোচিংয়ে পড়তে পড়তে বন্ধুত্বটা হয়েছিল | ঋত্বিকার মারকুটে স্বভাব, ওর রাগ, বাচ্চামো সবকিছুই সপ্তকের বড্ড পছন্দের ছিল | ঋত্বিকার ছোট ছোট আবদারগুলোর ভীড়ে সপ্তক নিজের ছোটবেলাটা খুঁজে পেত | সপ্তকের পরিবারে স্বাচ্ছন্দ্য থাকলেও আবেগের বড্ড অভাব | পরিবারের সব্বাই যেন যন্ত্রের মত কাজের দুনিয়ায় ব্যস্ত | বাবা-মা সপ্তকের সব চাহিদাপূরণ করলেও তাঁদের আন্তরিকতা চাপা পড়ে গিয়েছিল দম্ভ আর অহংকারের ভীড়ে | সেই কোন ছোট্টবেলায় সপ্তক বাবা-মার হাত ধরে মেলায় গিয়ে বেলুন, মুখোশ কিনেছিল | আজকাল ওর সেসব বিগত জন্মের কথা বলে মনে হয় | বাবা-মার ব্যস্ততায় মোড়া জীবনে সপ্তকের অস্তিত্বটুকুই আছে কিন্তু ওর কোন স্থান নেই | তাই ঋ যখন সপ্তকের কাছে ওই আবদারগুলো করে সপ্তক যেন নিজের ছোটবেলায় ফিরে যায় | খুব ইচ্ছে করে ঋয়ের সব আবদারগুলো পূরণ করতে, কঠিন ঝড়ের মাঝে তার আদরের ঋকে বুক দিয়ে আগলে রাখতে |
সপ্তকের আদরের ঋ আগছালো, বুনো, খামখেয়ালি, রাগী | তার যত রাগ সপ্তকের উপর | বেচারা সপ্তক ঋর খ্যাপামি সহ্য করতে করতে পাগল হয়ে যায় | উফফ্ কত আজব আইডিয়া যে আসে ঋ’র মাথায় | একদিন ওর ইচ্ছে হল সকালবেলা ময়দানে গিয়ে ট্রামে চাপবে, আর সেই ইচ্ছেপূরণ করতে গিয়ে মিথ্যে পরীক্ষার অজুহাত দিয়ে সপ্তককে আগের রাত্রে কাকুর বাড়িতে থাকতে হল | নইলে ম্যাডাম আর কার সঙ্গে ভোরবেলা ট্রামে চাপবেন? আর একবার ইচ্ছা হল সকালবেলা ট্যাংরাপট্টিতে গিয়ে চাইনিজ প্রাতরাশ খাবেন, ব্যাস আর কি সব কাজ ছেড়ে পুরো দিনটা ঋকে নিয়ে ঘুরে বেড়াতে হল | তবে মিথ্যে বলবে না সপ্তক, সত্যি ওর খুব আনন্দ হয় যখন সে দেখে এই ছোট ছোট খুশিগুলো পাবার পর ঋ কি সুন্দর বাচ্চাদের মতো খুশি হয় | আর একবার রেগে গেলে পুরো ঠোঁট ফুলিয়ে বসে থাকবে, একটাও কথা বলবে না….. সেই সময় চকোলেট কর্ণেটোর সলিউশনটা মাঝেমধ্যেই প্রয়োগ করে সপ্তক | ব্যাস ঋ একগাল হেসে দেয় | আর কথায় কথায় ব্রেক আপ তো লেগেই আছে… তুই সেদিন কেন ওই মেয়েটাকে দেখছিলি? কেন রিয়া সব্বাইকে ছেড়ে তোর কাছেই নোটস চাইল? বাইকে কেন দেবলীনাকে লিফট দিবি তুই, সারা কলেজে তুই কি একাই বাইক চালাস নাকি? এরকম বিচিত্র বিচিত্র কারণে ম্যাডামের রাগ হবে আর সে রাগ ভাঙাতে সপ্তকের নাজেহাল অবস্থা |
তবে এবারের ব্রেকআপের কারণ জগজিৎ সিং | সপ্তক গজলই বোঝে না তায় কে জগজিৎ, কে পঙ্কজ আর কেই বা তালাত? এদিকে ঋ গজলের, বলতে গেলে জগজিতের গানের অন্ধ ভক্ত | দোষের মধ্যে সপ্তক ঋকে ইমস্প্রেস করার চক্করে গাইছিল
‘ সোনে জ্যায়সা রঙ হ্যায় তেরা চাঁদি যায়সে বাল / এক তুহি ধনবান হ্যায় গোরি বাকি সব কাঙ্গাল ‘…সদ্য ইউটিউব দেখে গানটা শিখেছে সপ্তক, গায়কের নাম কে বা মনে রাখে, ব্যাস খেয়ে গেল কেস | গানটা শেষ হয়েছে কি হয়নি, ঋয়ের বোমা, বলতো কে গেয়েছেন গানটা? আত্মবিশ্বাসে ভরপুর সপ্তকের জবাব ছিল কেন? জগজিৎ সিং | ঋ আবার জিজ্ঞেস করল কী বললি? তখনই সতর্ক হওয়া উচিত ছিল সপ্তকের | কিন্তু তা না হয়ে সপ্তক আবার বলল জগজিৎ সিং | আসলে ঋর কাছে জগজিতের নাম শুনে শুনে সপ্তক গজল বলতে জগজিতকেই বোঝে | ব্যাস আর কি ঝামেলা শুরু, ওটা পঙ্কজ উধাসের গান… গজল ভালো না লাগলে শুনবি না, জোর করে শোনার কোনও দরকার নেই, আমি বাড়ি যাচ্ছি | ব্যাস সপ্তক বুঝে গেল আবার ব্রেকআপ | এবারের রেশ কদিন চলবে কে জানে?
চাইনিজ খেয়ে মনটা একটু ভালো হল ঋত্বিকার | মোবাইলের চ্যাটবক্সটা অন করে সপ্তকের মেসেজগুলো পড়ছিল ঋ | আর ভালো লাগছে না, দুদিন হয়ে গেল কোনও ফোন, মেসেজ করেনি ছেলেটা | প্রতিবারই তো ঋ এরকম বোকা বোকা ব্রেকআপ করে, কিন্তু সপ্তক তো মানিয়ে নেয় তাকে | এবার তবে কি হল, একটু ভয় ভয় লাগছে ঋত্বিকার | তবে কি সোহিনী? ঋত্বিকা বোঝে সোহিনীর সপ্তককে খুব পছন্দ, মাঝেমধ্যেই নোটসের অছিলায় সপ্তকের সঙ্গে কথা বলতে আসে | সপ্তককে বললে হেসে উড়িয়ে দেয় ব্যাপারটা | যদি সোহিনী এই অবকাশে…সপ্তককে কি একবার ফোন করবে সে? এবার না হয় শ্রীরাধিকাই শ্রীকৃষ্ণের মানভঞ্জন করবে | এমন সময় দেখল মেবাইলটা বাজছে, তোরে বিনা জিন্দেগি সে কোই শিকবা তো নেহি….. শিকবা নেহি | এই তো হতচ্ছাড়া ফোন করেছে | আজ ওর একদিন কি আমার একদিন ! ঋত্বিকা খপাত করে ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে সপ্তক বলে উঠল, কীরে রাগুনি রাগ পড়েছে?
রাগ পড়বে মানে ? রাগের কি দেখেছ তুমি চাঁদু ! আগে বল দু’দিন কোথায় ছিলিস, বল এখুনি… এখুনি…. দু’দিন কার সঙ্গে কথা বলছিলি? সোহিনী নিশ্চয়ই….তুই আমার সঙ্গে এরকম করতে পারলি ? কি করে পারলি ? একঝাঁক প্রশ্নের সঙ্গে সমানে কেঁদে চলেছে ঋ |
হতচকিত সপ্তক ফোনের ওপার থেকে শুধু বলতে পারল, কাঁদছিস কেন ঋ, আমি তো এই কদিন জগজিৎ শুনছিলাম |
মানে? ঋর অবাক প্রশ্ন |
হ্যাঁরে, জগজিতের সব অ্যালবামের গানগুলো শুনলাম তো দু’দিন ধরে, তোর সবচেয়ে পছন্দের গায়ক বলে কথা |
তুই আমায় এত ভালোবাসিস?
হ্যাঁরে পাগলি, খুব খুব ভালোবাসি, শুধু তোকেই নয় তোর সমস্ত পছন্দগুলোকেই আমি ভীষণ ভীষণ ভালোবাসি | কেন বুঝিস না তুই ?
হুমম্ বুঝি তো, তাহলে জগজিতের একটা গান শোনা এখুনি….
ওপার থেকে ভরাট গলায় সপ্তক গেয়ে উঠল, ‘ কিসি নজর কো তেরা ইন্তেজার আজ ভি হ্যায় / কাঁহা হো তুম কে ইয়ে দিল বেকারার আজও ভি হ্যায়…. |’
©️ অনিন্দিতা
Leave a Reply