আহমদ ছফা’র দর্শনই ছফাকে প্রাসঙ্গিক করে তোলে : রহমতুল্লাহ লিখন।

0
675

আহমদ ছফাকে নিয়ে লিখতে শুরু করলে লেখার ক্ষেত্র দিনকে দিন প্রচণ্ডতা লাভ করে। কারণ হল তাঁর চিন্তার গভীরতা ক্রমশ প্রাসঙ্গিক এবং অতলস্পর্শ হয়ে উঠে। আজ লেখার বিষয়বস্তু হল আহমদ ছফার দর্শন । সেটাকে শিক্ষা ক্ষেত্রের ভিতর সীমাবদ্ধ রাখার প্রয়াসে থাকব। কারণ ছোট খাট এ ধরনের নিবন্ধে তাঁর দার্শনিক ব্যপ্তি পুর্নাঙ্গরুপে প্রাকাশ করে সম্ভব নয়, প্রকাশ করার আস্পর্ধা কারাও অপরাধ বলে আমি মনে করি।
এখন প্রশ্ন আসতে পারে ছফাকে নিয়ে লিখতে হবে কেন? এই সাওয়ালের জাওয়াব হল তিনি তাঁর সমসাময়িক কালকে অতিক্রম করেছেন, বলতে গেলে তাঁর কালকে অতিক্রম করেছেন, জয় করেছেন। বিভিন্ন চিন্তাবিদের মত অনুসারে বলা যায়, একজন মানুষ তাঁর কালকে জয় করেন বা অমর হন দুইটি কারণে; প্রথমটি হল যখন সে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠে, আর দ্বিতীয় হল নিজের সময় ও সংকটকে উপলব্ধি করে তা প্রকাশ করে থাকে। আহমদ ছফার কাল জয়ের বিবৃতি এই দুই কারণের খাপে খাপে মিলে যায়। হেতু হিসেবে বলা যায় তাঁর লেখাগুলো সাবলিলভাবেই দূরদর্শী এবং সদা প্রাসঙ্গিক। তাঁর বক্তব্যগুলো আজও আগুনের গোলার মত তেজদ্দীপ্ত ও সচল।
আসা যাক, ছফার শিক্ষা ক্ষেত্রের দার্শনিক ভাবনাগুলো নিয়ে। তিনি আমাদের স্বধীনতা উত্তর শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে ব্যপকভাবে উদ্বিগ্ন ছিলেন। যদিও সব দেশ প্রেমিকেরই এমন উদ্বিগ্নতা থাকা জরুরী। কিন্তু ছফা উপলব্ধি করেছিলেন যে আমাদের দেশের ধনিক ও শাসক শ্রেনির মাঝে তেমন কোন উদ্বিগ্নতা পরিলক্ষিত হচ্ছে না। যা আজ প্রকটভাবে আমাদের সামনে প্রতিয়মান। তাঁর মতে মধ্যবিত্ত যে শ্রেনি স্বাধীনতা সংগ্রামের মাধ্যমে জন্মলাভ করেছে তাদের জাতীয়তাবাদ ছিল দোদুল্যমান। এই দোদুল্যমান অবস্থায়ই শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য় পরবর্তী সময়ে দারুণভাবে ব্যাহত করেছে। বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের নির্জীব আচরনের ফলে ভাষা আন্দোলনের মাধম্যে যে অঙ্গিকারের প্রস্তাবনা দেয়া হয়েছিল তা চুড়ান্তভাবে পদদলিত হচ্ছে। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে, শিক্ষার্থীদের বিচারশীল চিন্তাশীল করে তোলার জন্য মাতৃভাষায় শিক্ষাদান অত্যন্ত জরুরি।
ব্যাঙের ছাতার মত স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের ইংরেজি মিডিয়াম স্কুল গড়ে উঠায় তিনি মহা বিরক্ত ছিলেন। তিনি এই ট্রেন্ডকে মনে করতেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের ওয়াদার বরখেলাপ। তাঁর মতে আইয়ুব আমল থেকেই এই সর্বনাশের সুত্রপাত। আইয়ুব আমলে আমাদের দেশে যে মধ্যবিত্ত শ্রেনিটা গড়ে উঠেছিল তারাই ভাবতে শুরু করেন ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষাকে মর্যাদার প্রতিভূ। তাদের এই ভাবনাই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মৌলিক ক্ষতিটা ডেকে নিয়ে আসে। ছফা বারবার প্রশ্ন তুলেছেন বিদেশী বা পশ্চিমা শিক্ষা আদৌতে আমাদের কোন কাজে আসে কিনা সেই প্রসঙ্গে। এই দৃষ্টিভঙ্গি দেখে অনেকেরই মনে হতে পারে ছফা হয়ত পাশ্চাত্য বিরোধী। করজোড়ে তাদের বলতে চাই তিনি পাশ্চাত্যবিরধী ছিলেন না। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি হল মাতৃভাষায় বদলিয়ে বা রূপান্তরিত করে আনতে হবে পাশ্চাত্য দরকারি জ্ঞানটুকুকে যা তাদের সাফল্যের পরিচায়ক। মোদ্দা কথা, গবেষণার মাধ্যম হতে হবে বাংলা। জ্ঞানের সামাজিকীকরণের প্রতি তিনি সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছেন।
তথাকথিত সিভিল সোসাইটির প্রতি সবসময় সোচ্চার ছিলেন। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে সে এই তথাকথিত সিভিলদের প্রতি বিদ্রোহ না করলে স্বাধীনতার মূল উদ্দেশ্য মাটি হবে। কারণ হিসেবে দেখিয়েছেন তাদের দাস্যমনোভাব। এই দাস্যমনোভাব ত্যাগ করার প্রতি জোড় দিয়েছেন। তাঁর চিন্তা ভাবনার গভীরতা এতটাই প্রকট ছিল যে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে দেশকে গড়ে তুলতে হলে মনস্তাত্বিক কাঠামোর বিনির্মাণ একান্ত জরুরি। সেই ভাবনা হতেই সুবিধাবঞ্চিত ছেলেমেয়েদের জন্য বিদ্যালয় গড়ে তুলেছেন। তাঁর মূল্যায়ন ছিল শিক্ষার মাধম্যই পারে একটি রাষ্ট্রের উন্নতি করতে।
আহমদ ছফাকে নিয়ে ভাবাবার বা তাঁর দর্শন নিয়ে গবেষণার প্রয়োজনীয়তা এখানেই বিদ্যমান। তা হল সমসাময়িক যে জাতিগত সামাজিক বিপর্যয় তাঁর ইঙ্গিত দিতে তিনি সমর্থ হয়েছিলেন তাঁর সময়ই। আমাদের শিক্ষাখাতে যে মৌলিক দুর্গতি আসবে তাঁর কারণও বাতলে দিয়েছিলেন সেই সময়েই। পাশ্চাত্য নির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা, বলতে গেলে প্রেক্ষাপটকে নিয়ে গবেষণা না করেই অন্ধ পদলেহনের সাথে পুঁজিবাদী ভাবনাকে আশ্রয় প্রশ্রয় ও আলু পটলের সাথে সার্টিফিকেটের পার্থক্য করতে না পারার যে ব্যর্থতা, তাই আমাদের এই ভিত্তিহীন কুলাঙ্গার শিক্ষাকাঠামোর জন্য দায়ী।
ছফার দুরদর্শিতা এখানেই যে তিনি কারণ বয়ানে সীমাবদ্ধ থাকেন নাই বরং উত্তরণের পথের দিশাও দেখিয়েছেন। আর তা হল শিক্ষা অর্জনের মৌলিকতায় ফেরত যেতে হবে । সাথে সাথে মাতৃভাষায় জ্ঞান চর্চার মাধ্যমে সৃষ্টি করতে হবে সর্বস্তর ব্যাপিয়া। তাঁর শিক্ষা ক্ষেত্রে দর্শন এর যে সার্থকতা এখানেই সত্য বলে প্রমাণিত হয়।
ছফার সৃষ্টিকর্ম, ভাবনা চিন্তার বিষয়গুলো নিয়ে গবেষণা এখন অতি আবশ্য়ক হয়ে পড়েছে। আমাদের দেশে যে তা হচ্ছে না একেবারেই তা কিন্তু নয়। তবে নীতিনির্ধারক মহলের আজব ভাবে তাঁর বিষয়ে নিরবতা এই গবেষণার গতিকে বাঁধা দান করে চলেছে। নিজেদের স্বার্থেই ছফাকে লালন করতে হবে। তাঁর চিন্তার শানে বিবেক ও বুদ্ধিকে শাণিত করতে হবে আমাদের নিজেদের প্রয়োজনেই।পরিশেষে বলা যায় যে, আহমদ ছফাকে নিছকই সাহিত্যিক বা বুদ্ধিজীবী হিসাবে মনে করলে ভূল হবে। তিনি হলেন একটি ঝড় যা এখনও চলমান। এই ঝড়ের ভিতর দিয়ে ব্যক্তি, সমাজ ,রাষ্ট্র যাই যাতায়াত করুক না কেন তারই ভেঙ্গেচূড়ে দরকরি মনস্তাত্বিক পরিবর্তন হবেই। কারণ বিপ্লবে মুক্তি আসে সবখানেই।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here