একটা রক্তাক্ত বিষুবরেখা! :: তন্ময় সিংহ রায়।।

0
573

পর্ব – ১

গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন দীর্ঘ তেরোটা বছর…!
আমার পূবের সূর্যোদয় ও পশ্চিমের সূর্যাস্ত হত তোর ভিতরেই!
একটা ঘন কুয়াশার বলয় বেষ্টন করে ছিল আমার সহজ মনটা’কে!
হঠাৎ একটা ভয়াবহ নিউক্লিয়ার বিস্ফোরণ!
যকৃত,পাকস্থলী, ক্ষুদ্রান্ত্র-বৃহদান্ত্রসহ সমগ্র শরীরের ভিতরের আন্দোলনটা ছিল বর্ণনাতীত!
রক্তাবৃত গোটা হৃদপিন্ডটা মুহুর্তেই মর্মান্তিকভাবে রূপান্তরিত হয়েছিল কয়েক লক্ষ অণু-পরমাণুতে!
যেদিন নির্দ্বিধায় ও খুব স্বাভাবিকভাবেই আমায় বলেছিলি….
“আমি তোকে আর ভালোবাসিনা!”

পর্ব -২
‘ভালোবাসি, জানিস তো যতটা সহজ মুখে বলাটা, ঠিক ততটাই কঠিন এই অর্থপূর্ণ বর্ণসমষ্টির বিশ্বাস ও মর্যাদা রক্ষা করাটা।
তাই ভাবনায় বিশ্বাস ও সততা রেখেই বলছি….ভীষণ ভালোবাসি তোকে, হ্যাঁ রে! ভালোবাসা বলতে যা বোঝায় তা-ই আমি বাসি তোকে!
বৈশিষ্ট্যগুলো আর পাঁচটা মেয়ের মতন হলেও আদর্শগত কিছু চিন্তাধারায় যে আমি ব্যাতিক্রমী তা আমি জানি কারণ, আমি আমাকে বুঝি।
প্রশ্ন যদি করিস আমাকেই ভালোবাসিস কেন? স্বতঃস্ফূর্ত প্রত্যুত্তর পাবি, অন্য কাউকে বাসিনি ও ইচ্ছে হয়ে ওঠেনি বলে।
আমি দুল চাইনা, শাড়ি চাইনা,
চাইনা জুতো ও দামি মোবাইল।
শুধু ভালোবেসে হাত’টা ধরে আমার রেটিনায় ডুবে বলিস, তোকেই ভালোবাসি রে পাগলি!
আমার আদর্শ তুই, আমার গর্ব তুই, আমার অহংকার তুই!
শুধু এমনিভাবেই সারাজীবন ধরে থাকিস আমার বিশ্বাসী হাতটা!’
মনে পড়ে গেল, সেই তোর’ই ভালোবাসা’র বিশ্লেষণের শুভারম্ভের প্রকৃতি ছিল এমনটা’ই।
দৃষ্টিহীন হয়ে পৃথিবীর সমস্ত বিশ্বাসগুলোকে তোর হাতে তুলে দিয়ে প্রত্যুত্তরে আমার আবেগপ্রবণ মন’টা মুখটা’কে শুধু বলতে নির্দেশ দিয়েছিল,
‘এ গ্রহে আমার একমাত্র উদ্ভিদ শুধু তুই!’

পর্ব -৩

তোর ভালোবেসে বলা সেই শব্দগুচ্ছের অশরীরী আত্মাগুলোর আজও ঘুরে বেড়ায় আমার শিরা-ধমনীতে!
রাস্তা’র ধুলোমাখা নোংরায় চরম অবহেলায় ও অযত্নে মুখ থুবড়ে আজও লুটিয়ে পড়ে আছে তোর নিপুণ কৌশলে অতি যত্নে সাজানো মিথ্যে প্রতিশ্রুতিগুলো!
হৃদয়কে বিদীর্ণ করে অসহায়ভাবে গুমরে গুমরে কাঁদছে আমার অন্ধ-বিশ্বাসগুলো আর আমি স্পষ্ট শুনতে পাই, আজও চিৎকার করে বলছে….
‘কি দোষ ছিল আমার একবার বলে যা!’
উত্তর আজও পাইনি!
দিনের পর দিন, রাতের পর রাত, পৃথিবীর যথাসম্ভব বিশ্বাসগুলোকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কুড়িয়ে নিয়ে এসে নিশ্চিন্তে ও নির্দ্বিধায় তিলে তিলে আমি তুলে দিয়েছিলাম শুধু তোর ওই কোমল হাতে!
ভেবেছিলাম, শরীর দুটো হয় হোক না, বাঁচতাম তো একটা হৃদপিন্ডকে নিয়েই!
তোর শ্বাসকষ্টে, না হয় স্তব্ধ হতই আমার নিঃশ্বাস!
আমার অক্সিজেনের সিংহভাগটাই তো ছিল শুধু তোর জন্যে!
প্রতিবারেই স্বর্গ-সুখ অনুভব করতাম তোর স্পর্শে!
বারে বারেই বলে উঠতাম,
তোর কোমলতা দিয়ে আরো একবার গ্রাস কর আমায়! আরো আরো…
আমি যে ধনী হতে চেয়েছিলাম তোকে নিয়েই!
চেয়েছিলাম তোর গন্ধে নেশাগ্রস্ত হতে! লোকে আমায় দিন-রাত ডাকতো মাতাল বলে!
প্রায় প্রতিদিন ওই নীল দীঘিটার পাড়ে বসে একান্তে নির্জনে আমি হাবুডুবু খেতাম তোর কাজল পরা ওই চোখে!
আমি বারে বারে তোকে বাধ্য করতাম আমার দৃষ্টি দিয়ে তোর ওই চোখদুটোকে ছুঁতে!
বলতাম যতক্ষণ পর্যন্ত আমার দেহের উষ্ণতা বৃদ্ধি না পাবে, আমাকে তুই ভিজিয়ে যা! লাগুক থার্মোমিটার ও অনেক ওষুধপত্র।
আমার হৃদস্পন্দনের গতি দ্রুত হলে হত তোরও, আমার আঘাত প্রতিধ্বনিত হত তোর বুকেও!
বুঝিসনি ভালোবাসি কতটুকু?

পর্ব – ৪

একটা নীল পৃথিবীকে তোর চোখে রেখেছিলাম,
তুই চোখের বালি ভেবে নিলি!
ভেবেছিলাম তৃষ্ণা এঁকে দেবো তোর দু’চোখেই , তুই চোখ বন্ধ করে দিলি!
আমার ডান অলিন্দে যে পালঙ্ক’টা পেতেছিলাম তা ছিল তোর’ই,
তুই মাথা রাখতে পারিসনি!
ভালোবাসলে যাওয়া যায় না। কিন্তু তুই চলে গেলি!
আর তো ফিরলি না!
আমার হৃদপিন্ডটা ফিরিয়ে দিয়ে যা,
ওটা যে তোর কাছেই!
আমার না বলা কথাগুলো যে আজও তোকে ছুঁতে চায়!
আসবি ফিরে?

পর্ব – ৫

তোর নূপুর পরা আলতা রাঙা লক্ষ্মী পা দুটো যে আজও আমি দেখতে পাই স্পষ্ট!
তুই আজ আর বোধ হয় আমার জন্যে নূপুর পরিস না, না রে?
এ স্মৃতি ও অনুভূতি’র আগুনে প্রতিদিন যে একটু একটু করে বহু বছর ধরে পুড়েছে আমার কোষগুলো! আজও পুড়ছে!
ওরা নিঃশব্দে চিৎকার করে বলছে শুনতে পাচ্ছিস? ‘আমরা যে আর পুড়তে পারছিনা!’
কারণ, কার্বন কণাদের আর পোড়ার থাকে না!
কি অসহনীয় জ্বালা-যন্ত্রণা!
তা তোর যেন কোনোদিনও না হয়!
অবহেলা করে হলেও, তুই একবার অন্তত দেখে যা!
ফিরে আয় আর একটাবার!
আমি জানি আমার কোনো দোষ নেই, তবুও বলবো…..
সব দোষ ছিল আমার!
শুধু একবার বলে যা, ভালোবাসী তোকেই!!

পর্ব – ৬

আজ প্রায় দীর্ঘ আটাত্তর বছর তিনমাস পূর্ণ হল। কোথায় আছিস? কেমন আছিস? বেঁচে আছিস কিনা!….সবটাই অতিক্রম করেছে আমার জানার পরিধিকে!
এ সংসার মহা-সংগ্রামে হয়তো তুই ভুলেছিস সব-ই!
বুকের ঠিক মাঝবরাবর টেনে দিয়ে গেলি একটা রক্তাক্ত বিষুবরেখা!
সারাজীবনের মতন আলাদা করে দিয়ে গেলি দুজনের গোলার্ধকে?
আজ ঠিক কতটা পরিমাণে তুই সুখী, সেটা দেখার একান্ত ইচ্ছেটা মাঝে মধ্যে প্রচ্ছন্ন থাকতেই চায়না!
ভালোবাসাটা কি জানিস?
ভালোবাসা বা প্রেম হল এক মানবিক অনুভূতি ও আবেগকেন্দ্রিক এক অভিজ্ঞতা রে পাগলী!
পরস্পর সন্নিহিত দু’বর্ণের মিলনকে যেমন বলা হয় সন্ধি অনুরূপ, পরস্পর সন্নিহিত একটি ছেলে ও একটি মেয়ের দুটি মনের উপযুক্ত মিলনকেই বলা হয় ভালোবাসা!
ভালোবাসা/প্রেম নামক দীর্ঘদেহি বাড়ি’টা দাঁড়িয়ে থাকে যে সমস্ত আদর্শ নামক স্তম্ভকে অবলম্বন করে তা হল,
ত্যাগ, বিশ্বাস, দয়া, মায়া, নিষ্ঠা, সততা, শ্রদ্ধা প্রভৃতি।
এর যে কোনো একটা/দুটো পিলারের ছোট্ট একটা ফাটল পরবর্তীতে রূপান্তরিত হতে পারে ভাঙনে, ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে সম্পূর্ণ বাড়িখানাই এমনকি, ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়ে নিশ্চিহ্ন হওয়াটাও কিঞ্চিৎ পরিমাণে আশ্চর্যের কিছুই নয় রে, যা তুই দিয়ে গেলি এ হেন প্রতিদান!

আদরের একমাত্র নাতিটা একদিন আমার প্রশ্ন ছুঁড়েছিল ‘দাদু তোমার শেষ ইচ্ছেটা কি?’
বলেছিলাম, ‘খুঁজে দিতে পারিস সেই দক্ষ অভিনেত্রীকে? কত সুখে সে আজ আছে দেখতে চাই আর হাসিমুখে আলিঙ্গন করতে চাই চিরনিদ্রাকে আন্তরিকভাবে!
আর শেষবার জানতে চাই কি দোষ ছিল আমার?’