মহিলা ঢাকির ঝাঁঝ : দিলীপ রায়।

0
650

(প্রথম পর্ব)
ঘোড়াডাঙা একটি বর্ধিষ্ণু গ্রাম । বাবলা নদীর তীরে অবস্থিত । চৌরীগাছা স্টেশনে নেমে সোজা পশ্চিমদিকে দুই কিলোমিটার হাঁটলে প্রথমে বাবলা নদী, তারপর খেয়া নৌকায় পার হলেই সরাসরি ঘোড়াডাঙা গ্রামে পদার্পণ । গ্রামটি নদী বরাবর অর্দ্ধেক কিলোমিটার লম্বায় । গ্রামটির রাস্তা অনেকটাই উঁচু । তবে রাস্তাটি বর্ষাকালে কর্দমাক্ত হয় না । ইটের মোরাম রাস্তা । রাস্তা দিয়ে হরকদম গরুর গাড়ি চলাচল করার দরুন রাস্তার মাঝখানে গাড়ির চাকা বসে রাস্তাটা চলার পক্ষে ভীষণ বিপজ্জনক । সাইকেল চালাতে গেলে ছোট ছোট স্কুলের ছেলেমেয়েরা প্রায়ই সাইকেল থেকে পড়ে গিয়ে গড়াগড়ি খায় । অমসৃণ রাস্তা দিয়ে বয়স্ক মানুষজন রাত্রির দিকে হাঁটাচলায় অস্বস্তিবোধ করেন । এহেন রাস্তার পূর্বদিকে অর্থাৎ বাবলা নদীর কিনার ঘেঁষে গ্রাম । গ্রামটি দীর্ঘদিনের । বিভিন্ন জাতির মানুষের বসবাস । তবে গাঁয়ে ব্রাম্মনদের সংখ্যা বেশী । গাঁয়ের মোড়ল আবার ব্রাম্মন সমাজের মাথা । আশে পাশের গ্রামের মানুষ গাঁয়ের মোড়ল শিবদাসবাবুকে ভীষণ মাণ্য করেন । পুরো নাম শিবদাস আচার্য । গাঁয়ের বিচার সভায় শিব দাস মোড়লের উপস্থিতি অবশ্যাম্ভাবী । গাঁয়ে কথিত আছে, শিবদাস মোড়ল বিধান না দিলে বিচার সভায় ন্যায্য বিচার অসম্ভব !
শিবদাস মোড়লের ব্যক্তিগত জীবনে জটিল সমস্যা একটাই, সেটা বায়েন পাড়ার শিবু বায়েনের ছোট মেয়ে খেমটিকে নিয়ে । শিবদাস মোড়ল মনেপ্রাণে চান, বায়েন পাড়ার চল্লিশ ঘর বায়েনদের ঘোড়াডাঙা গ্রাম থেকে উচ্ছেদ করতে । তীব্র অভাবের তাড়নায় এবং অন্য সম্প্রদায়ের উৎপীড়নে, কমতে কমতে বায়েনদের বসতির সংখ্যা এখন চল্লিশ ঘরে এসে দাঁড়িয়েছে । শোনা যায় ঘোড়াডাঙা গাঁয়ের বায়েন পাড়া ষাট বছর আগে অনেক রমরমা ছিলো । নিজেদের মধ্যে গান-বাজনা, পূজা-অর্চনা নিত্য লেগেই থাকতো । কয়েকঘর বায়েনদের আবার মাঠে জমি জায়গা ছিলো । আর্থিকভাবে সেইসময় তাঁরা ছিলো যথেষ্ট স্বচ্ছল । বায়েন পাড়ায় সপ্তাহে দুদিন হাট বসতো । তাঁদের গোয়াল ভরা গরু ও জমিতে চাষবাস, ভরা সংসার নিয়ে বায়েনদের সাংসারিক জীবনে খুশীর অন্ত ছিলো না । ঢাকের বাজনা তাঁদের সংস্কৃতির মুখ্য বাদ্য । ঢাকের তালে মহিলাদের নৃত্য পরিবেশন তদানীন্তনকালে ছিলো ভীষণ জনপ্রিয় । চৈত্র সংক্রান্তির প্রাক্কালে গাজন মেলায় বোলান গানের সঙ্গে বায়েন পাড়ার মহিলাদের নৃত্যের দৃশ্য দেখতে দূর দূর থেকে মানুষের ঢল নামতো । কিন্তু কালের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আর প্রকৃতির ধ্বংসাত্মক রোষে বিশেষ করে বন্যার ভয়াবহতার কারণে বায়েন পাড়ার একজোট হয়ে থাকা মানুষ ছত্রভঙ্গ হয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেলেন । তাঁদের মধ্যে বদ্ধ ধারণা জন্মায়, বায়েন পাড়ায় বিশালাক্ষ্মী মায়ের কুদৃষ্টি পড়েছে, যার জন্য গাঁয়ে সেই সময় প্রতি বাড়িতে অসুখ-বিসুখ অহরহ । ১৯৭৮ সালের সর্বনাশা বন্যায় বায়েন পাড়া বন্যার জলে ধুয়ে মুছে প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা । আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে কিছু মানুষ ভরতপুরের নিকট বসত বাঁধে । কয়েক ঘর বায়েন দূরে কয়লা খনি অঞ্চলে কাজের সন্ধানে গিয়ে আর ফিরে আসেন নি । কাজের অন্বেষণে বেশ কয়েকজন মানুষ পারি দিয়েছিল ভিন্‌ রাজ্যে অর্থাৎ অসম রাজ্যের চা অধ্যুষিত অঞ্চলে । তাঁরাও আর পুনরায় ঘোড়াডাঙার বায়েন পাড়ায় ফিরে আসেন নি । এখন শিবু বায়েন সহ জনা চল্লিশ ঘর মানুষের বসবাস । তাঁদের মুখ্য জীবিকা একমাত্র ঢাক বাজানো । পূজা পার্বন আর বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠান ছাড়া বছরের অধিকাংশ সময় তাঁরা নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন । তবে শিবু বায়েনের ঢাক বাজানোর বায়না না থাকলে সকালে আড়ত থেকে পাইকারি দামে মাছ কিনে বাজারে বসে সেই মাছ বিক্রি করে । আর বিকেলে রাস্তায় রাস্তায় ফুচকা নিয়ে ঘোরে । শিবু হিসাব কষে যেটা বুঝেছে, ফুচকা বেচে বরং তার লাভ বেশী । শিবু বায়েনের দুই মেয়ে । কোনো পুত্র সন্তান নেই । এইজন্য গাঁয়ের অনেক মানুষ অনেক কথা শোনায় । যেমন সারা জীবন খাটাখাটুনির সম্পত্তি, টাকা পয়সা জামাইয়েরা ভোগ করবে । ঐসব অপ্রাসঙ্গিক কথাবার্তায় শিবু বায়েন অবশ্য কান দেয় না । তার মনের ভিতর অদম্য আকাক্ষা, সে মেয়ে দুটোকে মানুষের মতো মানুষ করবে । তাই তার একটাই মনের বাসনা, “লোকে যা-বলে বলুক, আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল । মেয়ে দুটিকে আমি শিক্ষিত করবোই । তাদের নিজের পায়ে দাঁড় করাবোই ।“
ঘোড়াডাঙা গ্রামের শিবদাস মোড়লের একমাত্র ছেলে কুহক । বড় শহরে থেকে কলেজে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা । কিন্তু স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেওয়ার পর, এখনও পর্যন্ত তার চাকরি মেলেনি । কুহকের চেষ্টা চলছে অনবরত । দেশের প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাগুলিতে বসছে । কিন্তু সেইসব পরীক্ষায় পেরে উঠছে না । ফলে লিখিত পরীক্ষায় পাশ দূরঅস্ত, সুতরাং মৌখিক পরীক্ষার কথা উহ্য থাকাই বাঞ্ছনীয় । তবে কুহক সর্বভারতীয় স্তরের পরীক্ষায় বসে তার যে অভিজ্ঞতা সেখান থেকে সে বুঝতে পারছে, চাকরি পাওয়ার প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা সম্পূর্ণ অন্য ধরণের । পুথিগত বিদ্যা থেকে অনেকটাই আলাদা । সেইজন্য প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় নিজেকে তৈরি করার জন্য বাজারে যেসব পত্রিকা, জার্ণাল, বইপত্র রয়েছে, সেগুলি কিনে পড়ার দিকে ঝুঁকছে ।
শিবদাস মোড়লের সমস্যা কুহকের পড়াশুনা বা তার চাকরি নিয়ে নয় ! তাঁর একমাত্র পুত্র কিনা বায়েন পাড়ার নীচু জাতটার মেয়ের সঙ্গে মিশছে । কুহকের শিবু বায়েনের ছোট মেয়েটার সাথে ওঠাবসা । শেষে কিনা বায়েনদের মেয়েকে তার মনে ধরলো ! শিবদাস মোড়লের মনের ভিতর ভীষণ অশান্তি । নিজের গিন্নিকে ধমকিয়েও ছেলেকে পথে আনতে পারেন নি । তাঁর ছেলে আবার এককাট্টা । গোঁয়ার ধরণের । কারও কথায় টলার পাত্র নয় । গাঁয়ের ঘনাকে লাগিয়েছিলেন শিবদাস মোড়ল, বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ছেলেটাকে পথে আনতে । কিন্তু উল্টে ঘনা অর্থাৎ ঘনশ্যামকে কুহকের কাছে যাচ্ছেতাইভাবে অপমানিত হতে হয়েছে । বলা চলে কুহক ঘনাকে উত্তম মধ্যম ঝেড়েছে । শুধুমাত্র গায়ে হাত তুলতে বাকী ।
অগত্যা বেশ কিছুদিন পর শিবদাস মোড়ল একদিন দুপুরে খাওয়ার সময় সুযোগ পেয়েই ছেলেকে চেপে ধরলেন, “আমি তোমার বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি ।“
“হঠাৎ বিয়ে কেন ? চাকরি না পেয়ে আমি বিয়ে করবো না, একথাটা আগেই জানিয়েছি ।“ চটজলদি বেজার মুখে কুহকের জবাব ।
বাড়িতে বৌমা দরকার । বাড়ির কাজকর্মে তোমার মাকে সহযোগিতা করার জন্য একজন শক্তপোক্ত মানুষ দরকার ।
কই, মা তো এইকথা বলেনি । তুমিই বরং আমার বিয়ের জন্য মাতোয়ারা ।
মা বলুক বা না-বলুক, আমি তোমার মায়ের অসুবিধাটা বুঝি । তুমি এম-এ পাশ করেছো । ভাল পাত্রীর অভাব হবে না । তাছাড়া…… !
তাছাড়া আবার কী বাবা ?
তাছাড়া বেতাই গ্রামের ধনহরির বড় মেয়েটার জন্য তোমার প্রস্তাব এসেছে । শুনেছি, মেয়েটি দেখতে-শুনতে যথেষ্ট খাসা । বি-এ পাশ । তাঁরা আবার আমাদের স্বজাতি । বাবা সেখানকার ডাকসাইটে ব্যবসায়ী । এলাকায় প্রতিষ্ঠিত বড়লোক । অনেক উপঢৌকন দিতে রাজী । এক কথায় সম্বন্ধটা রাজযোটক ।
এবার বুঝেছি, বড় লোকের মেয়ে আনার জন্য তুমি কেন এত তৎপর ? কেনই বা উঠে পড়ে লেগেছো !
এই সব কী কথা বলছিস ?
বিয়েতে অনেক জিনিসপত্র উপঢৌকন হিসেবে পাবে । সেইজন্য নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করতে নিজের ছেলেকে তার নীতি বিসর্জন দিয়ে বিয়ে করতে চাপ দিচ্ছো !
তাঁর মেয়ের বিয়েতে উপযাজক হয়ে উপঢৌকন দিলে তাতে ক্ষতি কী ?
বাবার সঙ্গে মতের অমিল ঘটায় নিমেষেই কুহক রেগে একশা । ফলে বাবার সঙ্গে স্বাভাবিক কথাবার্তার ধারাবাহিকতা হারিয়ে ফেলে । বরং রুক্ষ ভাষায় কুহক তার বাবাকে জানিয়ে দিলো, “চাকরি না পেয়ে তার পক্ষে বিয়ে করা অসম্ভব ! আর তাছাড়া………… !
“আর তাছাড়া ?” শিবদাস মোড়ল ঔৎসুক্য দৃষ্টিতে কুহকের কথা শোনার জন্য তার দিকে তাকিয়ে রইলেন ।
আর তাছাড়া আমি একটা মেয়েকে ভালবাসি ।
“সর্বনাশ ! কাকে ভালবাসিস ?” আত্‌কে উঠলেন শিবদাস মোড়ল । একথা তো কাক-পক্ষীও টের পায়নি ।
বায়েন পাড়ার শিবু বায়েনের ছোট মেয়ে খেমটীকে ।
নীচু জাতের বায়েন পাড়ার শিবু বায়েনের নাম শুনতেই প্রচন্ড ক্ষেপে যান শিবদাস মোড়ল । নিজস্ব রুপ ধরে আপন ভঙ্গিতে গর্জে উঠে তিনি বললেন, “দেশে কী আর কোনো মেয়ে জুটলো না, শেষে কিনা নিম্নবর্গের বায়েনদের মেয়েকে ভালবাসলি ? যে কিনা তোর নখের যোগ্য নয় ।”
বাবার তড়পানির তোয়াক্কা না করে রাগে গজরাতে গজরাতে কুহক স্থান ত্যাগ করলো । তারপর হনহন করে বাড়ি থেকে বের হয়ে সোজা নদীর তীরে ফাঁকা নিরালা জায়গায় এসে বসলো । নদীর জল তখন স্থির । সূর্যের আলো জলের উপর পড়ার জন্য নদীর জল চিক্‌চিক্‌ করছে । বাবলা নদীর জলের স্রোত নিজস্ব গতিতে বইছে । পানকৌড়ি নদীর জলের উপর দিয়ে ঘুরছে, কিন্তু তার শ্যেন দৃষ্টি জলে । কখন মাছের সন্ধান জোটে । ইতিমধ্যে ক্ষনেকের ঝড়ো হাওয়ায় নদীর জলে মৃদুমন্দ ঢেউ । দূরে ডিঙি নৌকা নিয়ে মাছ ধরতে ছুটছে বায়েন পাড়ার কার্ত্তিক সোরেন । সঙ্গে তার স্ত্রী । দুজনেই ডিঙি নৌকার দাঁড় টানছে । কার্ত্তিকের চেয়ে বরং তার বৌয়ের বইঠা টানার জোর বেশী । ফলে স্রোতের অনুকূলে ডিঙি নৌকা খুব দ্রুত ছুটছে । দূরে নদীর কিনারে সম্ভবত পশুর মৃতদেহ ভাসমান, যার জন্য মৃত পশুর দেহের উপর শকুনের আনাগোনা । আরামে তারা তাদের প্রিয় আহার খেতে ব্যস্ত । অন্যদিকে মরা পশুর জন্য চারিদিকে দুর্গন্ধের ছড়াছড়ি । কুহক চটজলদি নাকে রুমাল দিয়ে খানিকটা দূরে গিয়ে বসলো । স্রোতের টানে নিমেষেই পচাগলা মৃত দেহটা দূরে অদৃশ্য হয়ে গেল । এতক্ষণ কুহক নদীর পারে বসে দৃশ্যগুলি অবলোকন করছিলো । মনটা তার আনমনা । তাই কোথাও না গিয়ে নদীর পারে সটান বসে রইলো । সূর্য ক্রমশ পশ্চিমাকাশে । অথচ বাড়ি ফিরে যেতে তার মন কিছুতেই চাইছিলো না । বাবার রুদ্রমূর্তি ! মায়ের নীরবতা । সবকিছু তার কাছে দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ । খেমটিরা জাতিতে বায়েন সম্প্রদায়ের, অর্থাৎ নিম্ন বর্গের । তাই বলে তারা ব্রাম্মন সমাজে কেন অচ্ছুৎ ? গোটা ব্যাপারটা কুহককে ভাবিয়ে তুলছে !
খেমটীকে কুহক ভালবাসে । কেন ভালবাসে সেটা কুহকের পক্ষে বোঝানো কঠিন ! ভাললাগা থেকেই খেমটীকে ভালবাসা ।
তারপর …………?
তারপর সেদিন শনিবার । কলেজের পাঠ শেষ । স্নাতক ডিগ্রির ফল বের হতেও অনেক দেরী । তারপর রেজাল্ট বের হলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি । ঠিক এই মুহূর্তে কুহকের কাছে অফুরন্ত ফুসরত ।
বেলডাঙ্গার বন্ধু ‘সায়ন’ কুহককে আমন্ত্রণ জানালো তাদের বাড়িতে সন্ধ্যারাত্রিতে মানত করা কালী পূজা দেখার । কুহকের স্কুল জীবনের সহপাঠী সায়ন । তাদের মধ্যে বন্ধুত্বের নিবিড়তা খুবই দৃঢ় । কিন্তু স্কুলের পড়াশুনার পাট চুকে যাওয়ার পর সায়ন মেডিকেলে পড়ার সুযোগ পায় । যার জন্য সে এখন মুর্শিদাবাদ মেডিকেল কলেজে পাঠরত । ছোটবেলার বন্ধু সায়নদের বাড়িতে শনিবার কালী পূজা । গ্রামে গঞ্জে মানত করা কালী পূজা সাধারণত শনিবার কিংবা মঙ্গলবার সংঘটিত হয় । বাড়ির পূরোহিত মশায়ের নির্দেশ মতো সায়নদের বাড়িতে শনিবার সন্ধ্যায় কালী পূজো । যদিও সায়নরা জাতিতে কায়েত সম্প্রদায়ের । কায়েতরা আবার ব্রাম্মন পুরোহিত ঠাকুরের বিধান খুব মানেন । এটা নাকি তাঁদের সমাজ জীবনে বংশ পরম্পরা । তাই পুরোহিতের বিধান মেনে কালী পূজোর ঘনঘটা । আয়োজনের ত্রুটি নেই । সায়নের মা ও বাবা নির্জলা উপোস । রাত্রি নয়টা থেকে পূজা শুরু । সায়নের মাসিমা পূজোর আয়োজন ও তত্বাবধানের মধ্যমণি । তিনিও নির্জলা উপোস । কুহক জানতে পারলো, অনেক কষ্টে নাকি কালী মায়ের গলার মালার জন্য একশত আটটি জবা ফুল সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে । সায়নের কাছে কুহক আরও জানতে পারলো, মাসিমা নাকি একশত আটটা জবা ফুলের জন্য অস্থির হয়ে উঠেছিলেন । সায়নের বাবা ও মা সূর্য উদয়ের প্রায় সাথে সাথে ভাগীরথী গঙ্গায় গিয়ে গঙ্গা স্নান সেরেছেন । গঙ্গা স্নানের পর পিতলের এক কলসী গঙ্গা জল সঙ্গে নিয়ে এসেছেন । ঐ গঙ্গা জল দিয়ে মায়ের পূজো । তাছাড়া কুহক যতোটা জানতে পেরেছে, ঐ গঙ্গা জল দিয়ে প্রথমেই পূজোর সরঞ্জামের শুদ্ধিকরণ এবং তারপর পূজোর যোগাড়যন্ত্র । মাসির তদারকিতে প্রচন্ড নিয়মনিষ্ঠার কড়াকড়ি ।
একটু আগেভাগেই সায়নদের বাড়িতে কুহক পৌঁছেছিলো । সূর্য তখন অস্তাচলে । কুহকের মায়ের তাগাদার জন্যই সায়নদের বাড়িতে তার তড়িঘড়ি আগমন । কেননা সায়নদের বাড়ি অনেকটা দূরে । যাওয়াটাও ঝকমারি । প্রথমে তাদের গাঁয়ের সামনের বাবলা নদী পার হয়ে সোজা চৌরীগাছা স্টেশন । পুরোটাই হাঁটা পথ । তবে ইদানীং রিক্সা চলে । কিন্তু দরকারের সময় রিক্সার দেখা পাওয়া ভগবানের দেখা পাওয়ার সমতুল । তারপর চৌরীগাছা স্টেশন থেকে কিছুটা গিয়ে গঙ্গার ঘাট । সেখান থেকে ভাগীরথী গঙ্গা পার হয়ে হাঁটা পথে বেলডাঙ্গার চৌরাস্তা মোড় । চৌরাস্তার মোড় থেকে সায়নদের গ্রামে পৌঁছাতে প্রায় এক কিলোমিটার । কুহকের মা পইপই করে বলে দিয়েছেন, পূজো শেষে রাত্রিতে বাড়ি না ফিরতে । ভজঘট রাস্তা ঘাটের কারণেই তাঁর পরামর্শ । তাছাড়া দিনকাল ভাল না । রাস্তাঘাটে অনেকরকম অবাঞ্ছিত হুজ্জুকি হওয়ার সম্ভাবনা এড়িয়ে দেওয়া যায় না । তাই তার মায়ের পরামর্শ, পরের দিন বাড়ি ফেরাটাই যুক্তিসঙ্গত । সেই সময় মায়ের কথায় মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে বাড়ি থেকে কুহক রওনা দিয়েছিলো ।
সায়নদের বাড়িতেই মায়ের মূর্তি অর্থাৎ প্রতিমা তৈরির কাজ চলছে । কুহক সায়নদের বাড়ি পৌঁছে দেখে, মায়ের মূর্তিতে অলংকার পরাতে মৃৎ শিল্পী ব্যস্ত । প্রায় দশ ফুট উঁচু মায়ের মূর্তি । তাছাড়া পুজোর জমজমাট আয়োজন । গোটা বাড়িটায় প্যান্ডেলে ঘেরা । গ্রামের কতিপয় মানুষ পূজোর নানান কাজে ব্যতিব্যস্ত । বাড়ির উত্তরদিকে অতিথিদের জন্য রান্না-বান্নার কাজ চলছে জোরকদমে । পূজোতে খিচুড়ি প্রসাদ । কিন্তু আমন্ত্রিত অতিথিদের জন্য নিরামিষ খাবারের তোড়জোড় । মেনুতে কুহক লক্ষ্য করলো ফ্রায়েড রাইস, বিভিন্ন সবজির সমন্বয়ে যেমন গাজর, ফুলকপি, বিন, কাজু, কিসমিস, ইত্যাদির মুগ ডাল, আরও দুটো তরকারি এবং দই – মিষ্টি । তবে বহরমপুর থেকে আনা খাঁটি দুধের রাবড়ি আর একটা অনন্য সংযোজন । কুহকের ধারণা পূজো চলাকালীন খাওয়া-দাওয়ার পর্ব একই সঙ্গে চলবে ।
বাড়ির হৈ-হট্টগোল, কাজকর্মের তোড়জোড়ের মাঝে মাসিমার অস্বাভাবিক আচরণে কুহক খানিকটা মর্মাহত । বাড়ির শিশুর দল খেলাচ্ছলে পূজোর আশ-পাশ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারছে না । ছোট ছোট নিস্পাপ ছেলেমেয়ে কোনো কারণে পূজোর মন্ডপের আশে পাশে পৌঁছালে মাসিমার চিৎকার, “ছুঁবি না, পূজোর সরঞ্জামে হাত দিবি না ।“ এইসব চিৎকারের পরে তিনি মৃদু গলায় বলতে থাকেন, “বেহায়া ছোকরার দল ! জাতপাতের ঠিক-ঠিকানা নেই । অপবিত্রতায় ভরা । তাদের কিনা সরাসরি মায়ের পূজা মন্ডপে প্রবেশ । বলিহারি এদের বাপ-মা । ছেলে মেয়ে গুলিকে হাত-পা ধুইয়ে ভাল পোশাক পরিয়ে পূজা মন্ডপে পাঠাতে পারে, তা না করে দড়ি ছেঁড়া ছাগলের মতো বাড়ি থেকে তাদের ছেড়ে দিয়েছে । ছি ছি ।“ এইসব অপ্রাসঙ্গিক কথাবার্তা বলেই শিশুদের তাড়িয়ে দিয়ে তারা যেসব স্থানে ঘোরাঘুরি করেছিলো সেই স্থানে গঙ্গা জল ছিটিয়ে জায়গাটা পবিত্র করলেন । কুহক সায়নের মাসির কান্ড-কারখানা দেখে নিজের মনেই ভাবছে, আজকের ডিজিটাল যুগে দাঁড়িয়ে মাসিমার চিন্তাভাবনা এখনও মান্ধাতা আমলের । কুসংস্কারের ঘেরাটোপে তিনি আজও ষলোআনা আবদ্ধ । মাসির ঐসব কান্ডকারখান দেখে কুহক নিজেই চুপ হয়ে রইলো । মাসিমাকে কিছু বলাটা অশোভনীয় হতে পারে ভেবে কুহক চুপ থাকলো, প্রতিবাদ হিসাবে কোনো সতর্কমূলক কথা উচ্চারণ করলো না ।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে । ইত্যবসরে পুরোহিত ঠাকুর মহাশয় উপস্থিত । পূজা মন্ডপে পুরোহিত ঠাকুর মহাশয় পৌঁছানোর পর বাড়িতে হুলস্থুল । সায়নের মাসিমার তখন ব্যস্ততা চূড়ান্ত । “কে কোথায় আছিস, পুরোহিত ঠাকুর মশায়ের পা ধোয়ার জন্য এক বালতি জল ও একটা নতুন গামছা নিয়ে আয় ।“ মাসিমার তীব্র হাঁকডাকে সায়নের মা এক বালতি জল ও একটা নতুন গামছা নিয়ে সোজা পুরোহিত ঠাকুরের সামনা-সামনি ।
সায়নের মাকে দেখা মাত্রই মাসিমা বললেন, “এবার ঠাকুর মশায়ের পা ধুইয়ে এবং গামছা দিয়ে পা মুছিয়ে ঠাকুর মশায়কে মন্ডপে বসা । আমি বরং দুব্বা পাতা ও বেল পাতা জোগাড় করি ।“ বলেই তিনি অন্যত্র ছুটতে উদ্যত ।
এতক্ষণ কুহক চুপচাপ সব লক্ষ্য করছিলো । কিন্তু মাসিমার কান্ডকারখান দেখে নিজেকে সংযত রাখতে না পেরে বলেই ফেললো, “এটা কী হচ্ছে মাসিমা ?”
“কোন্‌টার কথা বলছো বাবা ?” মাসিমা জানতে চান ।
পুরোহিত ঠাকুর মশায়কে কেন পা ধুইয়ে দিতে হবে ?
“এসব তুমি বুঝবে না । তোমরা আজকালকার ছেলেপুলে, সুতরাং পূজা-আচারের নিয়মকানুনের মর্ম কী বুঝবে ?” মাসিমার উত্তরে যথেষ্ট বিরক্ত প্রকাশ ।
“আপনি কী বোঝাতে চাইলেন, আমার মাথায় ঢুকলো না । তবে…?”
“তবে কী বাছা ?” অপ্রসন্ন মাসিমার প্রশ্নের ধরণটা একটু আলাদা ।
“তবে পুরোহিত মহাশয় ব্রাম্মন । পুরোহিত মহাশয়কে পা ধোয়ালে সমস্ত ব্রাম্মন অতিথিদের পা ধোয়ানোটা আপনাদের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে । পুরোহিত বলে তাঁদের আলাদা কোনো জাতিসত্বা নেই । যে কোনো পৈতাধারি ব্রাম্মন যেমন প্রয়োজনে মূর্তি পূজা করতে পারেন, তেমনি অব্রাম্মনরাও মূর্তি পূজা করতে পারেন । এখন এটা স্বীকৃত । সুতরাং পা ধোয়ানোটা বন্ধ রাখলে আখেরে সমাজের মঙ্গল ।“
সমাজের কথা উঠতেই পুরোহিত মশায় তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন । তিনি ধৈর্যচ্যুতি ঘটিয়ে মাসিমার সুরে সুর মিলিয়ে কুহককে সরাসরি আক্রমণ করে বললেন, “তুমি যেই হও ছোকরা, আমার পূজোর কাজে বাধা দিতে এসো না । পূজো করাটা আমার পেশা । আমরা শাস্ত্র মেনে পূজা করি । সমাজের মঙ্গলের ব্যাপারে শাস্ত্রের বিধান তুমি কী বুঝবে ?”
কুহক বুঝতে পারলো, এক তরফা চিৎকার হচ্ছে । সায়নদের বাড়িতে পূজো । সুতরাং কিছুক্ষণ পর পরিবারের শান্তির স্বার্থে সায়নও তার যুক্তি এড়িয়ে যাবে । মাসিমা কিংবা পুরোহিত মশায়কে যুক্তি দিয়ে বোঝালেও তাঁরা কিছুতেই বুঝবেন না । সুতরাং কুহক কথা না বাড়িয়ে পুরোহিত ঠাকুর মশায়কে বললো, “আপনার জায়গায় আমি ব্রাম্মনের ছেলে হওয়ার সুবাদে পূজো করলে স্বয়ং জগতজননী মা কালী সেই পূজায় বরং সন্তুষ্ট হতেন বেশী । শুধু তাই নয়, এখন যে কোনো মানুষ, তিনি পুরুষ হোন বা মহিলা হোন, তাঁরাও ঠাকুরের মূর্তি পূজার উপযোগী । তাঁদের মূর্তি পূজো করতে আইনগত কোনো বাধা নেই । ইদানীং একজন উপজাতি সম্প্রদায়ের মেয়ে সরস্বতী পূজা করেছেন এবং সেই পূজো-পদ্ধতি ঐখানকার সমাজ এমনকি সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক সহ অন্যান্য শিক্ষক মহাশয়গণ এক বাক্যে মেনে নিয়েছেন । তাই বলছি, আপনি সায়নদের বাড়িতে মায়ের পূজা করার জন্য আমন্ত্রিত, সেই কারণে আপনার সঙ্গে আর বাদানুবাদে গেলাম না । তবে আপনাদের চিরাচরিত একপেশে ধ্যান-ধারণা ক্রমশ অবসানের পথে । এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা । আপনাদের বস্তাপচা দৃষ্টিকটু চিন্তাভাবনাগুলো এবার পাল্টাবার পালা । সম্ভব হলে অচিরেই পাল্টান । তাতে সমাজের মানুষেরই মঙ্গল ।
কুহকের কথা শুনে পুরোহিত মশায় মাথা ঝাঁকিয়ে মুখ ফুটে উচ্চারন করলেন, “হুম !” তিনি বোঝাতে চাইলেন, তোমাদের ভয় দেখানো কথবার্তায় তিনি আদৌ বিচলিত নন । পুরোহিতদের পুরোহিতগিরি যেমন চলছে, তেমনি চলবে । যজমান মানুষেরা গুরুদেবের মতো পুরোহিত ঠাকুরের পা ধুয়ে দিলে আখেরে তাঁদেরই সমাজে প্রভাব প্রতিপত্তির গৌরবোজ্জ্বল মর্যাদা । সেদিনকার ছোকরা কী বললো আর না বললো, তাতে ব্রাম্মন পুরোহিতদের কিচ্ছু যায় আসে না । চিরাচরিত প্রথার পরম্পরা একনিমেষে খন্ডাবার নয় । তারপর আড়চোখে কুহককে এক ঝলক দেখে নিয়ে পা ধোওয়ার পর মায়ের পূজোর স্থানে ঢুকে গেলেন । পা ধোয়ানোর পর সায়নের মা জায়গাটা পরিস্কার করে অন্যত্র ছুটলেন । তিনি সর্বক্ষণ নীরব রইলেন । এমনকি এক বারের জন্যেও কুহককে চুপ করতে বললেন না । সায়নের মায়ের নীরব থাকাটা কুহকের সাহসের সঞ্চার ঘটালো । তার মনে প্রচন্ড কৌতুহল, তাহলে কী সায়নের মা কুহকের কথার সাথে একমত !
হঠাৎ সায়ন কোথা থেকে ছুটে এসে কুহকের হাত টেনে ধরে বললো,”আমার সঙ্গে বাজার যেতে হবে । শিগ্‌গির চল ।“
হঠাৎ বাজারে কেন ?
“আর বলিস্‌ না, পূজোর জন্য ঘৃত-মধু আনা হয়নি । মাসিমা সমানে চিল্লিয়ে যাচ্ছেন । সেই কারণে এক্ষুণি বাজারে গিয়ে দশকর্মার দোকান থেকে ঘৃত মধু আনতে বললেন ।“ সায়ন এক নাগাড়ে কথাগুলি বললো ।
“হ্যাঁ নিশ্চয়ই । কখন যাবি ?” কুহকের সপ্রতিভ উত্তর ।
মোটর সাইকেল রাস্তায় দাঁড় করানো । এক্ষুণি চল্‌ ।
তারপর মোটর বাইকে দুজনে চেপে বাজারে দশকর্মার দোকানের উদ্দেশ্যে ছুটলো ।
রাস্তায় হঠাৎ ভূপতির সঙ্গে দেখা । সে স্কুটিতে বাজার থেকে ফিরছিলো । মুখোমুখি দেখা হওয়ার জন্য তারা রাস্তার উপরেই বাইক ও স্কুটি দাঁড় করালো । তারপর তিন বন্ধুতে অনেক কথা । কলেজ থেকে বের হওয়ার পর এই প্রথম সাক্ষাৎ । যদিও সায়নের সঙ্গে স্কুলের গন্ডি পার হওয়ার পর এই প্রথম দুজনের দেখা । ভূপতি একটা প্রাথমিক স্কুলে মাস্টারি করছে । বাড়িতে অভাব । তাই চটজলদি স্কুলের চাকরিতে যোগদান । ভূপতি জানালো তার বাবার চিন্তাভাবনা ছিলো, ছেলের প্রাইমারি স্কুলে চাকরি আর মাঠের জমি জায়গায় চাষবাস । ব্যস, এইটুকুই বেঁচে থাকার পক্ষে যথেষ্ট । বাবার চিন্তাভাবনার বাস্তবায়নে বাড়িতে যেমনি খুশী তেমনি ভূপতি নিজেও খুশী । যার জন্য সে বিন্দাস রয়েছে । এবার সায়ন ও কুহকের দিকে তাকিয়ে বললো, “এবার তোদের খবর শুনি ।“
সায়ন জানতে চাইলো, “তুই ঘর সংসার কবে বাঁধছিস্‌ ?”
সেইজন্যেই ঘোরাফেরা । কুহকের দিকে তাকিয়ে ভূপতি বললো, “তোদের গাঁয়ের বায়েন পাড়া থেকে একটি সম্বন্ধ এসেছে । মেয়েটি শুনলাম উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পর আর কলেজে ভর্তি হয়নি ।“
“তুই কার কথা বলছিস্‌ । তার নামটা কী ?” কুহক জানতে চাইলো ।
আরে তুই তাকে ভালভাবে চিনবি । শিবু বায়েনের বড় মেয়ে তনিমা ।
“শুনেছি, তার মেয়ে দুটিই ভদ্র এবং কর্মঠ । এখনও সেভাবে তাদের সঙ্গে হৃদ্যতা জমে উঠেনি ।“ কুহক ভূপতিকে জানালো ।
সঙ্গে সঙ্গে সায়ন দুজনের উদ্দেশ্যে জানালো, আজ তাদের বাড়িতে মা কালীর পূজায় ঐ শিবু বায়েন ঢাক বাজাবে । এলাকায় ঢাকি হিসাবে তার খুব নামডাক । এজন্য তাকে মায়ের পূজায় ঢাক বাজাতে বায়না করা হয়েছে ।
একগাল হাসি হেসে ভূপতি গর্ব সহকারে বললো, “তাই নাকি ?”
“হ্যাঁ ।“
তারপর ভূপতি আবার একগাল হেসে বললো, “দেখিস্‌ আমার ভাবী শ্বশুরের যত্নাদির যেনো কোনো ত্রুটি না হয় । তার অসম্মান মানে আমারও অসম্মান ।“
সেকথা বলতে । যত্নাদি নেওয়ার ব্যাপারে আমার সঙ্গে কুহক রয়েছে । তবে একটি কথা, পুনরায় ভূপতির দিকে তাকিয়ে সায়নের সহাস্য নিবেদন ।
আবার কী কথা ?
আজ আমাদের বাড়ির কালী পূজোতে তোমাকে নিমন্ত্রণ । অবশ্যই উপস্থিত থাকা চাই । তোমার অপেক্ষায় আমরা রইলাম ।
এবার ভূপতি সায়নকে আস্বস্ত করে বললো, “সে তাদের বাড়ির কালী পূজোতে অবশ্যই আসছে ।“
তারপর যে যার স্থানে ধাবিতো হোলো । দশকর্মার দোকান থেকে ঘৃত মধু নিয়ে সায়ন ও কুহক সোজা পূজোর মন্ডপে । ইতিমধ্যে পুরোহিত মশায় পূজো শুরু করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন । অন্যদিকে সায়নের মাসিমার গলা ফাটানো চিৎকার সমানে চলছে । তিনি চিৎকার করে বাড়ি মাতিয়ে শোরগোল বাধিয়েছেন । তাঁর একটাই কথা, “কোন্‌ আহাম্মক্‌-ঢাকি বায়না নিয়েছে, অথচ ঠিক পূজার সময় তার দেখা নেই । বায়েনদের এতটা আস্পর্ধা হয় কী করে ?”
সায়নের বাবা সায়নকে দেখতে পেয়ে বললেন, “তুই শিবু ঢাকির বাড়ি চিনিস্‌ ?”
তার বাড়ি কুহকদের গাঁয়ে । অনেক দূর ।
হ্যাঁ । কিন্তু এখন সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত্রি আটটা পনের মিনিট । অথচ ঢাকি এসে পৌঁছালো না ? পুরোহিত ঠাকুর মশায় বলছেন, তিনি রাত্রি নয়টায় পূজো শুরু করবেন । ঢাকি না এলে পূজো শুরু হবে কী করে ?
ঠিক আছে বাবা, তুমি টেনশন করো না । আমি কুহকের সঙ্গে এই প্রসঙ্গে কথা বলছি । তোমার কাছে ঢাকির ফোন নম্বর থাকলে, দাও !
একটা নম্বর দিয়েছিলো, কিন্তু যতোবার ফোন করছি ফোনে একই কথা শোনা যাচ্ছে “নট রিচেবল” । তাই কী করবো বুঝতে পারছি না । নিরুপায় হয়ে তোকে বললাম, “তুই একটা ব্যবস্থা কর্‌, যাতে ঢাকি পূজোর আগে পৌঁছাতে পারে । অন্যথায় তোকে বায়েন পাড়া অবশ্যই যেতে হবে । ঢাকি ছাড়া মা-কালী পূজো অসম্ভব !”
বাবা-ছেলের মাঝখানে হঠাৎ কুহক এসে উপস্থিত । কুহকের কৌতুহলি প্রশ্ন, “কোনো সমস্যা সায়ন ?”
“এখন সমস্যা ঢাকিকে নিয়ে । ঢাকি এসে না পৌঁছানোর জন্য পুরোহিত ঠাকুর পূজোয় বসতে পারছেন না ।“ সায়ন উদ্বিগ্নতার সঙ্গে কুহককে জানালো । (চলবে)

দিলীপ রায় (+৯১ ৯৪৩৩৪৬২৮৫৪)