আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলতে পারি :: তন্ময় সিংহ রায়।।।

0
1681

‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলতে পারি!’
১৯৫২ সালের ২১ তারিখে সংঘটিত বাংলা ভাষা আন্দোলনের এক করুণ ও মর্মস্পর্শী ইতিহাসের আর্ত চিৎকার আজও জীবন্ত এই গানটিতে।
দিনটি অধিক তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে আছে, বাঙালী জনগণের ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে এক হৃদয়বিদারক ও গৌরবোজ্জ্বল স্মৃতিবিজড়িত দিন হিসাবে।
বঙ্গীয় সমাজে বাংলা ভাষার অবস্থান নিয়ে বাঙালির আত্ম-অম্বেষায় উন্মেষ ঘটে যে ভাষাচেতনার, তারই সূত্র ধরে বিভাগোত্তর পূর্ববঙ্গের রাজধানী ঢাকায় ১৯৪৭ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বরে শুরু হয় ভাষা-বিক্ষোভ।
১৯৪৮-এর মার্চ মাসে এ নিয়ে আন্দোলনের সূত্রপাত হয় সীমিত পর্যায়ে এবং ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ঘটে যায় তার চরম বহিঃপ্রকাশ!
ঐদিন সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ১৪৪ ধারা অমান্য করে রাজপথে বেরিয়ে এলে
নির্বিচারে ও নির্দয় চিত্তে পাকিস্থানী পুলিশের গুলিতে সদ্য ঢাকায় আগত মাতৃভাষাপ্রেমী বছর ৩৩-এর এক বীর সন্তান আবদুল জব্বার রক্তাক্ত অবস্থায় লুটিয়ে পড়েছিলেন বাংলা মায়ের কোলে ও কয়েক ঘন্টা পরে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে ঢলে পড়েন মৃত্যুশয্যায়!
এলোপাথাড়ি গুলি বর্ষণে, একটি গুলি ছুটে যায় হোস্টেলের ১২ নং শেডের বারান্দায়। সেখানে গুলি গিয়ে বিদ্ধ করে সদ্য মাস্টার্স-এ ভর্তী হওয়া ২৫ বছরের আবুল বরকতের দেহকে! দূর্ভাগ্যবশতঃ যন্ত্রণাবিদ্ধ শরীর নিয়ে রাত আটটা নাগাদ তিনিও ত্যাগ করেন শেষ নিঃশ্বাস!
আরো যারা শহীদ হয়েছিলেন এই ভাষা আন্দোলনে (প্রায় ১২ জন) তাদের মধ্যে ছিলেন আব্দুস সালাম।
পেশায় তিনি ছিলেন ডিরেক্টরেট অব ইন্ডাস্ট্রিজ বিভাগের পিয়ন, থাকতেন নীলক্ষেতের কোয়ার্টারে। ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গের বিক্ষোভে অংশ নেন, আর পুলিশের এলোপাথাড়ি গুলিতে তিনিও লুটিয়ে পড়েন মাটিতে, কিন্তু মৃত্যু তৎক্ষণাৎ ছিনিয়ে নিতে পারেনি তাকে।
মারা যান দেড় মাস পর অর্থাৎ ৭ ই এপ্রিল, মাত্র ২৭ বছর বয়সে।
এছাড়াও অতি দুর্ভাগ্যজনকভাবে পুলিশের গুলিতে মারা যায় অহিউল্লাহ নামের একজন ৮/৯ বছর বয়সী শিশুও!
এ নিন্দনীয় ঘটনার তীব্র প্রতিবাদের আগুনে ক্ষুব্ধ ঢাকাবাসী সমবেত হয় ঢাকা মেডিকেল হোস্টেলে।
নানা পাশবিক নির্যাতন সত্ত্বেও ছাত্রদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষও প্রতিবাদ জানাতে পরের দিন অর্থাৎ ২২ ফেব্রুয়ারি পুনরায় নেমে আসেন ঢাকার রাজপথে। তারা অংশগ্রহণ করেন মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে শহীদদের জন্য অনুষ্ঠিত গায়েবি জানাজায়।
ভাষা শহীদদের স্মৃতিকে অমর করে রাখার জন্য ২৩ ফেব্রুয়ারি এক রাতের মধ্যে মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে গড়ে ওঠে একটি স্মৃতিস্তম্ভ। কিন্তু পিছু না ছাড়া দুর্ভাগ্য অর্থাৎ তৎকালীন সরকার ২৬ ফেব্রুয়ারি তাও দেয় গুঁড়িয়ে!
অতঃপর একুশে ফেব্রুয়ারির এই ঘটনার মধ্য দিয়ে ভাষা আন্দোলন হয়ে ওঠে আরও বেগবান!
আন্দোলনকারীদের দোষ ছিল একটাই,
মায়ের ভাষার ইজ্জৎ-কে যে কোনো মূল্যে রক্ষা করা।

সর্বশেষ ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দে কানাডার ভ্যাঙ্কুভার শহরে বসবাসরত দুই বাঙালি রফিকুল ইসলাম এবং আব্দুস সালাম প্রাথমিক উদ্যোক্তা হিসেবে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণার আবেদন জানালে, তৎকালীন জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনান ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ ই নভেম্বর অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে একুশে ফেব্রুয়ারিকে ঘোষণা করেন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। এবং ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে দিবসটি পালিত হচ্ছে জাতিসঙ্ঘের সদস্যদেশসমূহে যথাযথ মর্যাদাকে কেন্দ্র করে।