মনুষ্যত্ব, মানবতা ও মানবধর্ম — একটি পর্যালোচনা : দিলীপ রায় (+৯১ ৯৪৩৩৪৬২৮৫৪)।

0
634

আমরা জানি, মানুষের মধ্যেই মনুষ্যত্ব বিরাজমান । মনুষ্যত্বহীন মানুষকে মানুষ বলা সমাজের দৃষ্টিতে প্রচন্ড কঠিন । সমাজের দৃষ্টিতে মনুষ্যত্বই মানুষের সুপ্ত গুণাবলীর মধ্যে অন্যতম গুণ । সুতরাং এটা বলা যায়, মানুষ মনুষ্যত্বের অধিকারী । মানুষ্যত্ববোধ, মনুষ্যত্বের বিকাশ ও মানুষের কার্যকর অস্তিত্বের মধ্যেই “মানুষ’এর প্রকাশ । তাই বলা চলে, মনুষ্যত্ব ছাড়া মানুষ নয় । মনুষ্যত্ব আছে বলেই মানুষ অর্থাৎ মনুষ্যত্ব ধারণ বা লালন করে বলেই মানুষ । এখানে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের কথাটা প্রনিধানযোগ্য, “ভালো-মন্দের দ্বন্দের মধ্যে থেকে মানুষ ভালোকে বেছে নেবে বিবেকের দ্বারা, প্রথার দ্বারা নয় – এই হচ্ছে মানুষ” । মনুষ্যত্বের সঠিক প্রকাশ সমাজের কাছে মঙ্গল । আবার বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের অন্য চিন্তায় ‘মনুষ্যত্ব’ বলতে বুঝিয়েছেন সৃজনশীলতা । সৃজনশীলতাকে তিনি ‘ধর্ম’ বলে অভিহিত করেছেন । রবীন্দ্রনাথ কিন্তু ‘ধর্ম’ বলতে প্রতিষ্ঠানিক ‘ধর্মের’ কথা বলেননি । রবীন্দ্রনাথের কাছে ধর্ম কোনো আচার অনুষ্ঠান নয়, রবীন্দ্রনাথ এখানে ‘ধর্ম’ বলতে মানুষের মনুষ্যত্বকেই নির্দেশ করেছেন ।
মনুষ্যত্ব আমাদের অন্তরের বিষয়। আর এই অভ্যন্তরীণ বিষয়কে জাগ্রত করতে আমাদের চাই আন্তরিক ইচ্ছা । এই মনুষ্যত্ব গড়ে তুলতে আমাদের চাই মানসিক শক্তি, অন্তরের দৃঢ় বিশ্বাস, যা আমাদের প্রগতির পথে এগিয়ে যেতে ও বিভিন্ন বিপদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সাহায্য করবে । এই ক্ষেত্রে স্বামী বিবেকানন্দের কথায় আসা যেতে পারে । তিনি মানুষকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, “নীতিপরায়ন ও সাহসী হও । কাপুরুষেরা পাপ করিয়া থাকে, বীর কখনও পাপ করে না—এমনকি মনে পর্যন্ত পাপ আনতে দেয় না । সিংহ-গর্জনে আত্মার মহিমা ঘোষণা কর, জীবকে অভয় দিয়ে বল – “উত্তিষ্ঠিত জাগ্রত প্রাপ্য বরান্‌ নিবোধিত” —ওঠ, জাগো, লক্ষ্যে না পৌঁছানো পর্যন্ত থামিও না । এস মানুষ হও । …… নিজেদের সংকীর্ণ গর্ভ থেকে বেরিয়ে এসে বাইরে গিয়ে দেখ, সব জাতি কেমন উন্নতির পথে চলেছে । তোমরা কি মানুষকে ভালবাস ? তোমরা কি দেশকে ভালবাস ? তাহলে এসে, আমরা ভাল হবার জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করি” ।
মানবতা হচ্ছে মানুষের বৈশিষ্ট্য । মানুষের জন্য ভালবাসা, মানুষের জন্য সমবেদনা, স্নেহ মমতার নামই মানবতা । মানবতা কথাটার অনেক গভীর তাৎপর্য আছে, তবুও সাধারণ দৃষ্টিতে মানবতা হলো মানুষের ধর্ম বা বৈশিষ্ট্য যার দ্বারা একজন মানুষ পুর্নাঙ্গ মানুষে পরিণত হতে পারে । এক কথায় মানবতা হলো- মানুষের জন্য মানুষের ভালোবাসা, স্নেহ-মায়া-মমতা । মানবতা কি আপেক্ষিক ? আসলে এটা আপক্ষিক না হলেও আমরা এটাকে আপেক্ষিক বানিয়ে ফেলেছি । স্থান, কাল, ধর্ম ইত্যাদির উপর নির্ভর করে মানবতার রূপ ভিন্ন হতে পারে । একারণেই, আমরা স্টেশনের প্লাটফর্মের ছেলেটি যখন ডাস্টবিনে খাবার খোঁজে, যখন ক্ষুধার তাড়নায় ভিক্ষার জন্য হাত পাতে, তখন মানবতার অবক্ষয় খুজে পাই না । কিন্তু হাজার মাইল দুরের শিশুর জন্য মানবতা উথলে পড়ে । এটাকে আমরা বলবো মানবিক অবক্ষয় । আগে প্লাটফর্মের ধুলোমাখা ছেলেটির ক্ষুধা নিবারণ করো, তারপর দূরের মানুষের চিন্তা ! সুতরাং মনবতার প্রশ্নে অবক্ষয়ের গতিধারার প্রেক্ষাপট অবলোকন করা বাঞ্ছনীয় । এই প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে, অবক্ষয় শব্দের আভিধানিক অর্থ ‘ক্ষয়প্রাপ্তি’। ক্ষয়ে যাওয়া যেটাকে আমরা বলতে পারি পতন ঘটে যাওয়া, বিপর্যয় হয়ে যাওয়া। সামাজিক মূল্যবোধ তথা সততা, কর্তব্য পরায়নতা, নিষ্ঠা, ধৈর্য, উদারতা, শিষ্টাচার, সৌজন্যবোধ, নিয়মানুবর্তিতা, অধ্যবসায়, ইত্যাদি গুণাবলী নষ্ট হয়ে যাওয়াটাই সামাজিক অবক্ষয় । অবক্ষয়ের দিকে তাকালে দেখা যায় মানবিক অবক্ষয়, সামাজিক অবক্ষয়, মূল্যবোধের অবক্ষয়, নৈতিকতার অবক্ষয়, জাতীয় আদর্শের অবক্ষয়, ইত্যাদি । সুতরাং মানুষ মানবিক উপাদান নিয়ে জন্মগ্রহণ করবে এটাই স্বাভাবিক ।
মানবতা ও মানবসেবা একার্থক নয় । মানবসেবার মধ্যে পরোপকার জাতীয় একপ্রকার অনুভূতির জন্ম হয় । সেক্ষেত্রে স্বজ্ঞানে বা অ-জ্ঞানে বিশেষ অহংকারবোধের উদ্রেক হয় । তবে মানব সেবা মানবিক হতে পারে, যখন মানুষ অন্যের সেবা করে শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতিকে উপেক্ষা করে, নিঃস্বার্থ ভাবে অন্যের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করে, সেবা ও মানবিকতার আদর্শের মিলনকে স্বার্থক করে তোলে । মানুষের মানবিকতার উৎকর্ষতা নির্ধারিত হয় জগতে বিরাজমান সমস্ত জীবের প্রতি আচরণের নিরিখে । মানুষের নৈতিকতা, দায়দায়িত্ব, কর্তব্যপরায়নতার বহিঃপ্রকাশ হয় এই মহান আদর্শের মধ্য দিয়ে । সুতরাং এই কথা বলাই যায় যে, মানবতা কোনো মতবাদ নয়, একটি আদর্শ ।
মানুষের সেবা এবং প্রকৃতি ও জীবজগতের সেবাই মানুষের ধর্ম । এর মধ্যে দিয়ে মনুষ্যত্বের প্রকাশ ও বিকাশ । মানব ধর্ম প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গৌতম বুদ্ধ কোনো প্রাতিষ্ঠানিকতাকে প্রশ্রয় না দিয়ে যে ধর্ম প্রবর্তন করেন তার মূল লক্ষ্য ছিলো মুক্তি, বন্ধনের হাত থেকে মুক্তি । ভারতীয় সংবিধান তৈরীর ড্রাফটিং কমিটির চেয়ারম্যান বাবা সাহেব আম্বেদকর, মানব ধর্মের পূজারী ছিলেন । যিনি তাঁর জীবনের প্রথম ও শেষ লক্ষ্য হিসাবে মানব ধর্মের প্রতিষ্ঠার কথাই বলে এসেছেন । আর সেকারণে হয় তো বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার কথা ভেবেছিলেন । আম্বেদকর সমাজ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন চেয়েছিলেন এবং সেই পরিবর্তনের ভিত্তি ছিলো অবিশ্রান্ত লড়াই ও সমাজ বদলের ভাবনা — এইসব ছিলো তাঁর জীবনের অঙ্গ । তাই মানবতার পূজারী আম্বেদকরও গৌতম বুদ্ধের উপলব্ধ সত্য – শ্রদ্ধা অপেক্ষা যুক্তিই শ্রেষ্ঠ, এই সত্যের উপর ভর করে মানব মুক্তি তথা মানবতার পথ প্রশস্ত করতে প্রয়াস করেছেন । জাত-পাত, বর্ণ ব্যবস্থার বিলোপ সাধনের উদ্দেশ্যে সাংবিধানিক স্তরে আইন প্রনয়নের মাধ্যমে এক শ্রেণীহীন আধুনিক সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে মানুষ হিসেবে সকলে সমান, ‘মানবিকতা বা মানবধর্ম’ যে প্রকৃত ধর্ম সেই বার্তা দিয়েছেন ।
গুরুত্বপূর্ণ ও উল্লেখ্যনীয় বিষয় হচ্ছে শিক্ষা । শিক্ষার মাধ্যমে মনুষ্যত্বের বিকাশ । মানুষ জন্ম নিলেই মানুষ হয়ে ওঠে না । তাকে কঠিন সাধনা করে মানুষ হতে হয় । আর মানুষ হওয়ার বিশেষ সোপান হল শিক্ষা । শিক্ষাই মানুষকে জীবসত্তা থেকে মানবসত্তায় পরিণত করে । শিক্ষা মানুষষকে সর্বাঙ্গীন বিকাশ সাধন করে । প্রকৃত মানুষ হতে গেলে শিক্ষার আলোয় আলোকিত হতে হবে । শিক্ষা মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্বের জাগরণ ঘটায় । মানব জীবনে ও মানব কল্যাণে মনুষ্যত্বের বিকাশ ও উৎকর্ষসাধন অপরিহার্য । রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “ মনুষ্যত্বের শিক্ষাটাই চরম শিক্ষা, আর সমস্তটাই তার অধীনে” । তাই মানুষ হিসেবে অন্য মানুষের অধিকার, কর্তব্য, দায়িত্ব এবং মর্যাদা সম্পর্কে আমরা সবাই সচেতন হলে মনুষ্যত্বের শিক্ষালাভও সহজ হয়ে যাবে । তাই মনুষ্যত্বের প্রশ্নে শিক্ষার প্রসঙ্গ ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক ও উল্লেখযোগ্য ।
পরিশেষে এটা পরিস্কার, মানুষ মনুষ্যত্বের অধিকারী । মানবতা হচ্ছে মানুষের বৈশিষ্ট্য । মানুষের সেবা করাই হচ্ছে মানব ধর্ম । জীব ঈশ্বরের এক মহান সৃষ্টি । প্রতিটি জীবের মধ্যে ঈশ্বর বর্তমান । জীবের সেবা করার মাধ্যমে ঈশ্বরের সেবা করা যায় । সেইজন্যেই স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, “জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর” । বাণীটি মানব কল্যাণের ক্ষেত্রে ভীষণভাবে তাৎপর্যপূর্ণ । তবুও বাণীটি নিঃসন্দেহে সময়োপযোগী । সুতরাং সমাজে মানব সেবার ক্ষেত্রে উক্তিটি ভীষণ প্রাসঙ্গিক ।
——————–০———————–
এ১০এক্স/৩৪, কল্যাণী-৭৪১২৩৫ (ভারত)