একজন অতৃপ্ত প্রতিভাবান অভিনয়শিল্পী ‘নির্মলেন্দু ঘোষ’ শেষ পর্যন্ত খুঁজে পেলেন “Flowers Of Haven”…

0
1443

কলকাতা, সৌগত রাণা কবিয়ালঃ- চেনা অচেনা বর্গীদের রক্তচোষা আঘাত সইতে সইতে হাজার বছরের সম্বৃদ্ধ একটি দেশ-মায়ের জরাজীর্ণ জরায়ু থেকে দূর্বল এক ইতিহাসের সৃষ্টি হয়ে ভারতীয় আধুনিক সভ্যতায় জন্ম হলো ‘সিমান্ত রেখা’ নামের এক অদৃশ্য সুইসাইড নোটের…
সেখানে দেশ ভাগে বিপর্যস্ত লক্ষ-কোটি মানুষ অসহায়ের মতো হঠাৎ নিজের মাতৃসত্তা থেকে ভীনদেশী হয়ে গেলো..
আসন-শাষন লোভী সদ্য স্বাধীন দেশের নেতাদের চকচকে ক্ষমতায় লোভ দেখে মাথা নিচু করে অসহায় নীরব হয়ে রইলেন আমাদের ‘বাপু’….!

সময়ে চারটি প্রজন্ম এগিয়ে গেছে অনেকটা পথ.. কিন্তু সেই মায়ের শরীরে কাঁটা ছেড়ার যন্ত্রণার কাঁটাতারের যন্ত্রণা বুকে নিয়ে ঋত্বিক ঘটকের মতো ক্ষণজন্মা মেধাবী দেশ সন্তানের মতো আরও অজানা অনেক মেধাবী মানুষের হাহাকার শ্রেফ আড়াল হয়ে গেলো সভ্যতার ম্যারাথনের রেপ্লিকা জয়ের নেশায়…;

‘নির্মলেন্দু ঘোষ’ তেমনি এক রক্তাক্ত হৃদয়ের এক অসাধারণ শিল্প প্রেমিকের নাম..!
সময়ে অকারণ অবজ্ঞা আর নিজ জীবনের প্রিয় শিল্পের অপ্রকাশ মেধার দীর্ঘ যন্ত্রণা সহবাসে, রাতের আধারে এক ঈশ্বরীয় আশির্বাদের আশায় চোখের সামনে ফুটে উঠতো..ক্যামেরা-একশান-রোলিং..! অসাধারণ সব চরিত্রে নিজেকে রুপান্তরিত করে তৃষ্ণা মেটাতেন তার অভিনয়ের নানান প্রিয় চরিত্রের.!

সময় রাজা গল্প লিখতে ক্লান্ত হয়নি কখনো.. তাই হয়তো একের পর এক কর্মজীবনের আপন মেধার সাফল্যের সুযোগ পেয়েও কিছুদিন পর পর ছুটে পালিয়ে বেড়িয়েছেন অন্তরের সত্তায় বাঁচতে গিয়ে…!

হঠাৎ পঁচাশি বছরে জীবন-ট্রেনের শেষ স্টপেজে নিজের সব স্বপ্ন ছুঁয়ে সুখী হওয়ার অঘোম তৃপ্তি পেতে, দেখা পেলেন এই সময়ের মেধাবী তরুণ চিত্রশিল্পী ও চিত্রপরিচালক শক্তিধর বীরের “সুখ পারিজাত”- এর…! কিন্তু স্বপ্নের পারিজাতের সেই সাফল্য দেখার আগেই হাসি মুখ নিয়ে বিদায় দিলেন তার যন্ত্রণার মহাকাব্যিক জীবনকে..! হয়তো নিজের স্বপ্নের শিল্প প্রকাশ করার পর উনার প্রাপ্তির ঘরে আর কিছুই পাওয়ার ছিলো না..! শিল্পের স্বীকৃতি নিয়ে ক্ষণজন্মা একজন অভিনেতা ‘নির্মলেন্দু ঘোষ’ নীরবে মিললেন পরম শান্তির সাথে…!

সুখ পারিজাতের পরিচালক শক্তিধর বীরের ভাষায়…
” নির্মলেন্দু শেষ পর্যন্ত খুঁজে পেয়েছিলেন “Flowers Of Haven”….!
সুখ পারিজাত ফুটছে আবার
ডাক পাঠালাম বন্ধু হবার—-
আয় বন্ধু খেলতে যাবো
সুখের রেনু মাখতে পাবো—-
সুখ পারিজাত (Flowers Of Heaven)…পুর্নদৈঘ‍্য চলচিত্রে বহুদিন পর পারিজাত এর খোঁজ পেয়েছিলেন পঁচাশি বছরের বর্ষীয়ান অভিনেতা নির্মলেন্দু ঘোষ। তিনি সত‍্যি সুখের রেনু মাখতে চলে গেলেন পার্থিব মায়া ছেড়ে 18th July 2021. তার অভিনীত সুখ পারিজাত ছবিটি 2020 এ সম্পূর্ন হয়েছে,যেখানে তিনি মূখ‍্য ভূমিকায় অভিনয় করেছেন এবং এই সিনেমাটি Indian National Film Division দ্বারা সমাদৃত হয়েছে ।
সিনেমাটিতে তিনি এক একাকী বৃদ্ধের ভুমিকায়, যে তার বিদেশে থাকা ছেলের অপেক্ষায় থাকে একরাশ অভিমান নিয়ে। সেখানে তিনি জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাত,আনন্দ-ক্রোধ এমনকি মৃত‍্যুর মুখোমুখি হওয়ার দৃশ‍্য ও অবলীলায় নিপুন অভিনয় দক্ষতায় ফুটিয়ে তুলেছেন।অভিনয়ের ইচ্ছা ছিল তাঁর বহদিনের। কিন্তু জীবনের নানা ঘটনার পাকে পড়ে, সংসারের দায়িত্বে অভিনয় এর কাছে আর পৌঁছাতে পারেননি।

 

একবার তরুণ বয়সে সিনেমাতে অডিশন দেওয়ার পর, এক বন্ধুর সুপারিশে সোজা গিয়ে দেখা করেন কাননদেবীর সাথে মুভিটোন স্টুডিওতে। কাননদেবী তাকে বলেছিলেন ‘আসা-যাওয়া করতে থাকো হবে’ । কিন্তু তার সেই নিয়মিত যাতায়াত করা আর হয়নি। তখন সবে মাত্র বাংলাদেশ থেকে এসেছেন। পাঁচভাই,চার বোন..যদিও তার মেজভাই পরিমল সংসারের হাল ধরে তাকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন ,কিন্তু তার নিজস্ব বোধ তাকে ছাড় দেয়নি।ক‍্যালকাটা টেকনিকাল স্কুল থেকে পাশ করার পর জেশপ কোম্পানীর কাজে ঢুকে পড়েন।সেখানে বেশিদিন মন টেকে না।বেরিয়ে এসে গননাট‍্য সংস্থার সাথে ঘুরে ঘুরে নাটক করতে থাকেন।তারপর এক বৈষ্ণব দলের আখড়ায় যোগ দেন। গৌড়ীয় ঘরানায় পথে পথে নাম সংকীর্তন করে বেড়াতেন। এরপর সব পেয়েছির আসরের মাধ‍্যমে শিক্ষা প্রদান করতে থাকলেন। নানারকম ভাবে নিজের পথ খুজছিলেন তিনি। ততদিনে বয়স চুয়াল্লিশ-পয়তাল্লিশ। এইসময় এক জীবন সঙ্গী পেলেন। তিনি মীরা। সন্তান হল।তখন তিনি দায়িত্বের দায়বদ্ধে আবার ভূমি-রাজস্ব দপ্তরে, ল‍্যান্ড রিফর্মার অফিসার হিসাবে যোগ দিলেন। কিন্তু বেশীদিন চলল না রোজকার কর্মে মূখ ডুবিয়ে থাকা।বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ডাকে যোগ দিলেন। ফিরে এসে আবার দেওঘর চলে গেলেন। ঠাকুর অনূকূলচন্দ্র এর সাথে কিছুদিন সঙ্গ করলেন। আবার ফিরলেন সংসারে। বারবার জীবনের খোঁজে তিনি ভ্রাম‍্যমান জীবনের হাত ধরেছিলেন। সারাজীবন এক খোঁজ, না পাওয়ার অস্থিরতা।


অবশেষে পঁচাশি পেরিয়ে
সুখ পারিজাত (Flowers Of Heaven) সিনেমাতে তিনি ঢেলে দিলেন তার দীর্ঘজীবনের আকাঙ্খিত শিল্পীর নিপূন দক্ষতা।অশীতিপর এক মানুষ ক‍্যামেরার সামনে নিজেকে মেলে ধরলেন যৌবনের ঊচ্ছাস নিয়ে। সাত বছরের শিশু স্বর্ণালের সাথে পর্দায় নাচলেন, গাইলেন। ছূয়ে ফেললেন মনের মনিকোটা।

” এই পৃথিবীর আলোছায়ায় বড্ড মায়া
একটুখানি আলোর পাশে একটু আবছায়া।”

(প্রথম ও শেষ গানের লাইনগুলি “সুখ পারিজাত ” সিনেমা থেকে সংগৃহীত)

একটা সময়, অনেক স্ফুলিঙ্গের জন্ম দেয়… দেশ-সমাজ-সভ্যতা তাকে মূল্যায়ন হয়তো কখনো কখনো করতেই পারে না.. তবুও নির্মলেন্দু ঘোষেরা আমাদের আগামী প্রজন্মের জন্য অনেক সুন্দর সন্ধ্যায় গল্প রেখে যায় বুকের ভেতর জীবনের প্রখর আগুন দুপুর নিয়েও…!
একজন শিল্পী তার শিল্প প্রকাশের যন্ত্রণা থেকে বঞ্চিত হওয়ার কষ্ট যে কতোটা ভয়াবহ তা কেবল সে শিল্পীই জানেন…!
ভালো থাকুন “নির্মলেন্দু ঘোষ”…
ভালো থাকুন আপনি…!!

—সৌগত রাণা কবিয়াল
( কবি সাহিত্যিক ও কলামিস্ট )