মগ্নজলের আশ্চর্য তরঙ্গেরা : তৈমুর খান।

0
345

শুভ্রাশ্রী ‘মাইতির মগ্নজলের মুহূর্তেরা’ (২০২১) ৬৪ পৃষ্ঠার কাব্যটিতে জীবনকে দেখার এক নতুন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হলাম। ‘সরপড়া পুকুরের মতো এ জীবন’ যখন মায়া চোখে চেয়ে দেখে, তখন প্রকৃতি ও প্রাণীর আবেগ ছাপিয়ে যায় নিত্যনৈমিত্তিক ক্রিয়ায়। মগ্নজলের মুহূর্তেরাই তখন কথা বলে ওঠে। আশাবরি জীবনের খিড়কি দুয়ার খুলে আশমানি আরশির সম্মুখীন করে। ব্রহ্মময় জীবনের চকিত উদ্ভাসে আত্মবিস্তার ঘটে কবিরও। সুগভীর মায়ায় তখন ভেসে যান প্রকৃতিযাপনের বিরাট সত্তায়। পাখির ভাষাকেও তখন আপন ভাষা মনে হয়। প্রত্নঅভীপ্সার জাগরণ থেকে ‘মমতাগন্ধ’ ভারী হয়ে আসে। অনন্ত উড়ানের ক্রিয়ায় উন্মুখ হয়ে ওঠে হৃদয়। পাখি ও ফুল হয়ে যাওয়া সন্তানদেরও তখন আশীর্বাদের প্রাপ্তি বলে মনে হয়। শাশুড়ি শান্ত আকাশ। স্বামী বসন্তদিনের সোনালি খবর। ননদ চাঁপার গন্ধ। আর কবি ধূপছায়া রোদ। পুরো পরিবারটি পাড়ার লোকের কাছে হয়ে যায় ‘বাগান’। অদ্ভুত উপলব্ধি। কবিতায় এরকম স্বাদু রোমান্টিক উপলব্ধির বাতাবরণ এক জাগতিক স্বপ্ন দৃশ্যের তৈরি করে দেয়। তখন মনে পড়ে যায় উনিশ শতকের সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারকারী ফরাসি সাহিত্যিক ভিক্টর হুগোর একটি উক্তি: ‘Life is a flower of which love is the honey’. চাঁদ, জ্যোৎস্না, রাত্রি সবই মায়াময় এক রূপকল্পের ছন্দে আবর্তিত হয়। শিহরনের মেদুর আবেশে পুলকিত হতে থাকি। ছেঁড়াখোঁড়া দুঃখ বিষাদ যাতনাগুলি আর পথ রুদ্ধ করতে পারে না। কবি বলেছেন:
‘ছাই সরিয়ে খুঁজে নেব পথ একদিন’
পথ তো সত্যিই খুঁজে নিয়েছেন। বসন্ত বাঁশির সুরও টের পেয়েছি। অভিমান বিকল্প কান্নার অভিরূপ। খুচরো দহন ব্যথার সলতে পাকিয়ে দ্বীপজ্বলা সন্ধ্যায় জীবনের নতুন আরাধনা শুরু হয়। ভালবাসার গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। পূর্ণিমা চাঁদ হেসে ওঠে ভালবাসার মানুষটির মতো। ‘আনন্দ-মাধুকরীর’ অব্যর্থ আয়োজনে পূর্ণ হয় জীবনপাত্র।
কবি লেখেন:
‘রোদজলে ভেজা মাটির মানুষেরা ভিড় করে আসে চারপাশে
পাতার আত্মীয়তায় বাড়িয়ে দেয় হাত, আশ্বাসের…
আমার ঝোলাটা ভরতে থাকে, ভরতেই থাকে আশ্চর্য নিরাময় রোদ্দুরে…’
এই ঝোলা ভরে যাওয়া নিরাময় রোদ্দুরকে ‘অমলকান্তির’ মতো পেয়ে যাই। রোদ্দুর আবহমান জীবনের উজ্জ্বলতাকে স্পষ্ট করে তোলে। দৈনন্দিন জীবনের সিঁড়িগুড়িতে উঠতে নামতে কবির বোধের জগৎ সচকিত হয়। আশ্চর্য উদ্দীপনা জাগায়। ভাষায় মর্মরিত হয় ইতিহাসের নানা পর্যায়। মনীষীলোকের বোধিকল্প ছায়া। ভালবাসা থেকে মৃত্যু পর্যন্ত পথপরিক্রমায় জীবনের অমৃতময় মুহূর্তগুলি মগ্নজলের আশ্চর্য তরঙ্গে কম্পন তোলে। সস্নেহ এক ধারা প্রবাহে পাঠকও অভিষিক্ত হন। ‘হাত ধরে চিনিয়ে দেয় পথ আমার জন্মের’ কবির এই উপলব্ধি আমাদেরও জীবনের পথকে চিনিয়ে দেয়। চার্লস ডিকেন্সের কথায়:
‘You’ve got the key of the street.’
(Charles Dickens, The Pickwick Papers)
অর্থাৎ তোমার কাছে রাস্তার চাবি আছে। এই রাস্তা জীবনের রাস্তা। কবি আমাদের হাতেও সেই চাবি তুলে দিয়েছেন। আবেগের এমন সূক্ষ্ম কারুকার্যময় প্রয়োগে এবং মিতকথনের ব্যবহারে মুগ্ধতার রেশ ছড়িয়ে দিয়েছেন কবিতাগুলিতে। আত্মবোধের নিবিড় জাগরণে সমগ্র কাব্য জুড়েই এমন আত্ম-উন্মোচন ঘটেছে। প্রাত্যহিক জীবনের স্বপ্ন-সংশয়-সংকট-বিশ্বাস-দোলাচল-সংগ্রামগুলি খুব সূক্ষ্মতার সঙ্গে মনস্তাত্ত্বিক পর্যায় দান করেছেন। আশ্চর্য রূপাকাশ্রয় বর্ণনা:
“এইযে চঞ্চলা রোদকিশোরী সকাল হতে না হতেই
কোমরে কাপড় এঁটে বেরিয়ে পড়েছে পাড়া বেড়াতে
সে তো দেখে এসেছে ঠিকই—
কেমন আঁট হয়ে বাঁধা আছে ভালোবাসা ফুলকপির ক্ষেতে
চিচিঙ্গাসুন্দরীরা তনুবল্লরী দুলিয়ে মুগ্ধ নয়নে চেয়ে আছে পাতার আড়ালে
আঙুল নাড়িয়ে হাতছানি দিয়ে ডাকছে লাজুক বরবটিলতা
আদরসোহাগি পুঁই ঢলে ঢলে পড়ছে বেড়ার কঠিন পুরুষালি বুকে চুম্বনে
নরম শিশিরে মুখ ধোওয়া কচি শশারা কুটিকুটি হেসে গড়িয়ে পড়ছে এ ওর গায়ে…”
মেটাফোর অলংকার প্রয়োগের এমন চমৎকার দৃষ্টান্ত বাংলা সাহিত্যে খুব কমই চোখে পড়বে। মনুষ্য জীবনের প্রবৃত্তিমুখিন চর্যাচর্যকে অতি দক্ষতার সঙ্গে প্রাকৃতিক বিন্যাস দান করেছেন। তাই তাঁর কবিতাগুলি হৃদয়কে স্পর্শ করে, মেধাকে আলোড়িত করে, জীবনকে গতিময়তার উৎসবে আলিঙ্গন করে।
প্রচ্ছদ শিল্পী জয়তী ধর পালকেও অভিনন্দন জানাই। তাঁর শৈল্পিক কুশলতা কাব্যের পক্ষে উপযুক্ত।
🌊
মগ্নজলের মুহূর্তেরা ― শুভ্রাশ্রী মাইতি
লিপি প্রকাশন, বাড়বড়িশা, কোলাঘাট, পূর্ব মেদিনীপুর-৭২১১৩৪
মূল্য – ৮০ টাকা মাত্র
ছবিতে শুভ্রাশ্রী মাইতি ও তাঁর কাব্যগ্রন্থ