ব্রহ্মবাদী কেশবচন্দ্রের মন পরিবর্তিত হয়েছিল ঠাকুর রামকৃষ্ণের কৃপাসান্নিধ্য পাবার পর । তিনি আকৃষ্ট হয়েছিলেন রামকৃষ্ণের ভক্তি ও বিশ্বাসে। প্রভাবান্বিত হয়েছিলেন। যার প্রভাব তাঁর ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মধর্মেও পরে । বৈরাগ্যের স্রোত দেখা যায় তাতে। আর যার দরুণ , জন্মসূত্র থেকে ভক্তিমার্গের ঘরানার বিজয়কৃষ্ণ পুনরায় ভক্তিধারায় অবস্নাত হয়ে কেশবচন্দ্র সেনের থেকে দীক্ষা গ্রহণ করে ফেলেন ।
বেশ, এবার প্রশ্ন যে, দীক্ষাই যদি নেবেন তবে আবার তাঁকে ত্যাগ করে দ্বিতীয় বার গুরুদ্রোহী হলেন কেন ?
এর উত্তর—কুচবিহার বিবাহ আন্দোলন। কেশবচন্দ্র সেন , বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীপাদ ও অন্যান্য ব্রাহ্মদের একান্ত উদ্যোগে ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে গভর্ণমেন্ট সিভিল বিবাহবিধি বিধিবদ্ধ করেন। এই বিবাহ আইন অনুযায়ী পাত্রের বয়স কমপক্ষে অষ্টাদশ(১৮) বৎসর এবং পাত্রীর বয়স পঞ্চদশ (১৫) বৎসর হতে হবে। এছাড়া আরো অন্যান্য নিয়মাবলীও ছিল। প্রথমে এই আইনের নাম ব্রাহ্মবিবাহআইন রাখা হবে স্থির হয়। পরে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আদি ব্রাহ্মসমাজের প্রতিকূলতায় গভর্ণমেন্ট আইনের নাম পরিবর্তন করে সিভিল বিবাহবিধি রাখে। কিন্তু ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে কেশবচন্দ্র সেন কুচবিহারের রাজার সঙ্গে নিজের কন্যার বিবাহ স্থির করেন, যখন কিনা রাজা এবং তাঁর কন্যা উভয়েই অপ্রাপ্তবয়স্ক। কেবলমাত্র রাজজামাতা আর আভিজাত্য প্রতিষ্ঠার লোভে অপ্রাপ্তবয়স্ক রাজার সঙ্গে অপ্রাপ্তবয়স্কা নিজের কন্যার এই বিবাহ দেওয়াকে বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী মেনে নিতে পারেননি। শুধু তাই নয়, কেশবচন্দ্র হিন্দু ধর্মের যে পৌত্তলিকতার ও ধর্মীয় রীতিনীতির তীব্র বিরোধ করে এসেছিলেন এতকাল , সেই পৌত্তলিকতা ও যাবতীয় হিন্দু আচার-অনুষ্ঠানকেই অঙ্গীকার করে নেন কন্যার বিবাহ প্রদানের সময়। ব্রাহ্মমতে কিন্তু বিবাহ দেন নি। যদিও তিনি বিবাহের কোন কর্মেই অংশগ্রহণ করতে পারেননি শেষমেশ। কারণ,স্মার্ত মতে পাশ্চাত্যদেশে গমন করলে জাত যায়। আর, কেশবচন্দ্র ইংল্যান্ডে গিয়েছিলেন বলে অর্থাৎ বিদেশ যাত্রা করেছিলেন বলে পাত্রপক্ষ তাঁকে কোন আচার অনুষ্ঠানে সাক্ষাৎ ভাবে অংশ নিতে দেয়নি। নিজের এহেন দ্বিচারিতাকে অর্থাৎ, সম্পূর্ণ বিবাহ ঘটনাকে ভগবানের আদেশ বলে প্রচার করতে থাকেন কেশবচন্দ্র। এই প্রচারকে ,এই ব্যবহারকে বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী অত্যন্ত অন্যায় বলে বোধ করতে থাকেন। তাঁর মনে হয় কেশবচন্দ্র নিজের মতবাদকে ঈশ্বরের নাম দিয়ে চালাতে চাইছেন এবং তা যদি করা হয় তাহলে তো ঈশ্বরের প্রতি ভালোবাসার ব্যাপারটাই রইল না। যেখানে কিনা জ্ঞানতঃ নিজের দোষকে ঈশ্বরের কাঁধে চাপানো হচ্ছে , তা তো একপ্রকার মিথ্যাচার , অন্যায়! অন্যায়কে বিজয়কৃষ্ণ কিছুতেই মন থেকে মেনে নিতে পারলেন না ।
১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দে যখন ব্রাহ্মবিবাহ বা সিভিল বিবাহবিধি প্রচলিত হয়েছিল, তখন কেশবচন্দ্র ব্রাহ্মমন্দির থেকে ঘোষণা করেছিলেন যে এই বিধি কেবল রাজবিধি নয় ঈশ্বরের বিধি তা। ঈশ্বরের আদেশেই সম্পন্ন হয়েছে বিধি। কিন্তু নিজের কন্যার বিবাহের ক্ষেত্রেই সেই আদেশ লঙ্ঘন করে এক নতুন আদেশ প্রচার করায় , সমস্ত ব্রাহ্মসমাজ যেন কলঙ্কিত হল বলে মনে হল বিজয়কৃষ্ণসহ অন্যান্য প্রতিবাদী ব্রাহ্মদের কাছে। বিজয়কৃষ্ণ সংবাদপত্রে প্রতিবাদ জানিয়ে লিখলেন, ঈশ্বরের আদেশ ব্রাহ্মদিগের ধর্মশাস্ত্র। তাহারা কোন কালে তা অস্বীকার করতে পারেন না। যথার্থ ঈশ্বরের আদেশকে আমরা সর্বান্তঃকরণে শ্রদ্ধাভক্তি করে থাকি । ঈশ্বর পবিত্র, অপরিবর্তনীয় যেমন, তেমন তাঁর আদেশও পবিত্র এবং অপরিবর্তনীয় । ঈশ্বরের আদেশ অসৎ, অপবিত্র এবং পরিবর্তনীয় বললে আমরা ঘৃণার সঙ্গে তা পরিত্যাগ করবো। এইভাবে বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী কেশবচন্দ্রের অন্যায় কাজের তীব্র প্রতিবাদ ও সমালোচনা করলেন। তিনি মনে মনে অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে কেশবচন্দ্রের সঙ্গে নিজের সমস্ত সংস্রব ত্যাগ করার সংকল্প গ্রহণ করলেন। অন্যান্য ব্রাহ্মরাও কেশবচন্দ্রের এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করলো। এবং ফলস্বরূপ হল কি কেশবচন্দ্র ও তাঁর শিষ্যরা আর অন্যান্য প্রতিবাদী ব্রাহ্মরা দু’দলে ভাগ হয়ে গেল । কেশবচন্দ্র যখন নিজের কন্যাকে নিয়ে কুচবিহারে যান, প্রতিবাদী ব্রাহ্মরা পত্র লিখে বিবাহ বন্ধ করতে অনুরোধ করেন। কিন্তু, সেই পত্র ছিঁড়ে ফেলেন কেশব। এছাড়া ভারতবর্ষীয় মন্দির নিয়ে দুই দলের মধ্যে অতিশয় কলহ শুরু হল যা কিনা হাতাহাতি রক্তারক্তিতে পর্যন্ত পরিণত হল । প্রসঙ্গত বলি ভারতবর্ষীয় মন্দির হল ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মধর্মের উপাসনা মন্দির যা কেশবচন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।অনেকগুলি ব্রাহ্ম পরিবারকে একসঙ্গে এক জায়গায় রেখে দৈনিক উপাসনা, ধর্মগ্রন্থ পাঠ ,সৎ প্রসঙ্গ , সংযমাদি সাত্ত্বিক নিয়মাবলী পালনের মধ্য দিয়ে আদর্শ ব্রাহ্ম পরিবার সংগঠন স্থাপন করার উদ্দেশ্যে কেশবচন্দ্র ভারতাশ্রম স্থাপন করেছিলেন। এবং এই কাজে বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী মহাশয় প্রধান উদ্যোগী হয়েছিলেন ও কেশবচন্দ্রের একজন প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।
পরিণাম এই দাঁড়ালো যে , কেশবচন্দ্র সেনের অনুরাগী শিষ্যদের দ্বারা নানান ভাবে বিজয়কৃষ্ণকে অপদস্থ করার চেষ্টা করা হল। তাঁর অনিষ্ট করারও বহু-বহু প্রচেষ্টা চললো।এমনকি তাঁকে প্রাণে মারার জন্য গুন্ডা পর্যন্ত লাগানো হয়েছিল। এই সমস্ত নানান ঘটনায় বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী ব্রাহ্ম সমাজের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। কেশবচন্দ্রের প্রতি শ্রদ্ধা হারিয়ে ছিলেন। আর তার দরুন তিনি দ্বিতীয় বার গুরুত্যাগী হয়েছিলেন।
এখন প্রশ্ন, পরবর্তীতে ব্রাহ্মধর্ম সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগের কারণ কি ?
——ভক্তকৃপাপ্রার্থিনী
রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক
প্রভুপাদ বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী— এক আশ্চর্য মহাজীবন কথা (৮) : রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক।

Leave a Reply