ঝিঙে পটল (ধারাবাহিক, ২২তম পর্ব) : দিলীপ রায় (+৯১ ৯৪৩৩৪৬২৮৫৪)।

0
313

অসহায়তা চারিদিক দিয়ে জাঁকিয়ে বসেছে ঝিঙেদের জীবনে । দাদার ব্যবসা রেল স্টেশনের প্লাটফর্মে এবং ঝিঙে থাকছে রূপকদের বাড়ি । যদিও দাদার ব্যবসা প্লাটফর্মে ভাল চলছে । সেদিক দিয়ে ঝিঙের দাদা মানসিকভাবে নিশ্চিন্ত ! কিন্তু তার থাকা-খাওয়ার নিয়মানুবর্তিতা পুরোটাই রসাতলে । বলা চলে এখন তার ছন্নছাড়া জীবন । অন্যদিকে ঝিঙে রূপকদের বাড়িতে উঠলেও থাকছে আলাদা একটা ঘরে । তার গতিবিধিতে বা চালচলনে কেউ তাকে বিরক্ত করে না, বরং রূপকদের বাড়ির মানুষ ঝিঙের নিজস্ব কাজের ব্যাপারে সর্বতোভাবে সহযোগিতা করে ।
ঝিঙে নিজেদের এইরূপ ছন্নছাড়া জীবন নিয়ে আর ভাবতে চায় না । সামনে তার সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা । সর্বভারতীয় এই পরীক্ষায় ঝিঙে এখন অনেকটাই ধাতস্থ । মানসিক দিক দিয়ে শক্ত । সুতরাং পরীক্ষা ভাল দেওয়ার নিরিখে ঝিঙে মনের দিক থেকে ষোলোআনা প্রস্তুত । সেই কারণে তার পড়াশুনার গতি স্বাভাবিক ছন্দে চলছে । তা সত্ত্বেও ঝিঙে এবার অনেক রেফারেন্স বই পড়ছে । প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতির স্ট্যাণ্ডার্ড জার্নালগুলি ঘাটছে । তার পরিশ্রম সমানে চলছে । এদিকে কিছুদিন পরেই প্রিলিমিনারি পরীক্ষা ।
বেশ কিছুদিন কেটে গেলো । সরকারি তরফ থেকে ঝিঙেদের বাড়ির টাকা পাওয়ার কোনো খোঁজ নেই । আদৌ কবে পাবে সেই ব্যাপারে কোনো সরকারি আধিকারিক হদিস দিতে পারছেন না । অগত্যা পটল স্টেশনের কাছে একটা ঘর ভাড়া নিলো । সেখানে একটি শোওয়ার ঘর, বারান্দা, রান্না ঘর ও বাথ রুম । নিজেদের বাড়ি নির্মাণের অনিশ্চিয়তা উপলব্ধি করে পটল বাড়ি ভাড়া নিতে একরকম বাধ্য হল । অবশেষে ঝিঙে ও পটল ভাড়া বাড়িতে গিয়ে উঠলো ।
ঝিঙে ঘর সংসার সামলিয়ে নিজের পড়াশুনায় জোর দিলো ।
প্রিলিমিনারি পরীক্ষা পাশ করার পরে লিখিত পরীক্ষায় ঝিঙে ভাল নম্বর পেয়ে পাশ করলো । তার এখন মৌখিক পরীক্ষার উপর নজর । আদা জল খেয়ে নিজেকে তৈরী করছে ঝিঙে । ঝিঙে তার স্যারদের পরামর্শ মতো অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ও সাম্প্রতিক কালের পাশ করা মানুষদের সাথে যোগাযোগ রাখছে । তাঁদের সঙ্গে আনুষঙ্গিক বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করছে । প্রশ্ন করার ধরন ও তার উত্তর দেওয়ার পদ্ধতি সবিস্তারে খুঁটিনাটি জেনে নিচ্ছে । ইতিমধ্যে বহরমপুরে গিয়েছিল ঝিঙে । সেখানকার অতিরিক্ত জেলা সমাহর্তা সাম্প্রতিক কালের আই-এই-এস । যদিও তাঁর বাড়ি অসম রাজ্যের শিলচরে । তিনি ঝিঙেকে সমস্তরকম টিপস্‌ দিলেন । তাতে ঝিঙে মানসিক দিক দিয়ে অনেকটাই চাঙা ।
মৌখিক পরীক্ষার তারিখ ঘোষিত হল ।
ঝিঙের সাথে পটল ও রূপক সাথী । এবছর ঝিঙে পরীক্ষা ভাল দেওয়ার নিরিখে মানসিকভাবে সম্পূর্ণ প্রস্তুত ।
আঁটোসাটো ড্রেসে ঝিঙে ইন্টারভিউ দিতে তৈরী । হাতে একটা ফাইল । লিস্টে তার নাম সাত নম্বরে । সকল প্রার্থীর মাঝে বসে রয়েছে ঝিঙে । সকল প্রার্থীই চুপচাপ । প্রত্যেকের ক্ষেত্রে আধা ঘন্টা বা তারও বেশী সময় নিচ্ছে ইন্টারভিউ বোর্ড । ঝিঙে শুধুমাত্র জেনে নিলো, ইন্টারভিউ বোর্ডের মানুষজনের ব্যবহারিক ধরন কেমন ? যেটা জানতে পারলো তাতে বোর্ডের সব মেম্বার খুব আন্তরিক ও সহযোগিতা মনোভাবাপন্ন ।
ছয় নম্বর প্রার্থী ঢুকেছে । এবার ঝিঙের পালা । বাইরে অপেক্ষায় রয়েছে পটল ও রূপক । পটল ফাঁকা জায়গায় বসে কায়মনোবাক্যে ঈশ্বরকে ডাকছে, তার বোন যেনো এবছর কৃতকার্য হয় । রূপক খবরের কাগজ উল্টিয়ে পাল্টিয়ে এমনকি চায়ের দোকানে চা খেয়ে সময় কাটাচ্ছে । ঝিঙের মৌখিক পরীক্ষা নিয়ে দুজনের মধ্যে উৎকন্ঠা ! গতবার কৃতকার্য না হওয়ার জন্য বোনের মৌখিক পরীক্ষা নিয়ে পটলের চিন্তাটা বেশী ।
ঝিঙে সোজা ঢুকে ইন্টারভিউ বোর্ডের সামনে । ঢোকার সময় ঝিঙে কোনো পারমিশন নিলো না । তার যুক্তি, বোর্ড সরকারি কর্মচারী মারফত ইন্টারভিউ দেওয়ার জন্য তাকে ভিতরে ডেকেছেন । সুতরাং পারমিশন নেওয়াটা বাধ্যতামূলক নয় । তারপর বোর্ডের মাঝখানের ব্যক্তি সম্ভবত বোর্ডের চেয়ারম্যান ঝিঙেকে বসতে বললেন, “টেক ইয়র সিট প্লিজ !”
“থ্যাংক ইউ স্যার ।“ বলার পরে ঝিঙে সামনে রাখা চেয়ারটায় বসলো ।
তারপর শুরু হল প্রশ্নোত্তর পর্ব ।
প্রায় পয়তাল্লিশ মিনিট । মৌখিক পরীক্ষা দিয়ে ঝিঙে খুব খুশী । আত্মবিশ্বাসে ভরপুর । সব কটি প্রশ্নের মধ্যে বেশীর ভাগ উত্তরগুলি ঝিঙে সুন্দরভাবে বলতে পারায় তার বিশ্বাস, এবার তার জয় হবেই ।
ঝিঙেকে নিয়ে পটল ও রূপক খাবারের দোকানে ঢুকলো । অনেকক্ষণ থেকে তাদের ভুখা পেট । ইন্টারভিউয়ের চিন্তায় ঝিঙের মাথা থেকে খাওয়া দাওয়া উধাও । এখন দাদার কাছে নালিশ, ভীষণ খিদে পেয়েছে ! রূপক মাছ ও মাংস ভাতের অর্ডার দিলো । খাওয়া দাওয়ার পর ফেরার পালা ।
বাড়ি ফেরার পর সরকারি অফিস থেকে পটল খবর পেলো, পটলের জায়গার বিনিময়ে যে দশ লাখ টাকা পাওয়ার কথা ছিল সেটা পাচ্ছে না । বিনিময়ে সরকার থেকে মেরে-কেটে তিন লাখ পেতে পারে । সেটার জন্য পটলকে সত্বর তার মতামত জানাতে হবে । নতুবা সেটাও বানচাল হওয়ার সম্ভাবনা । পটল পড়েছে ফ্যাসাদে । দশ লাখ টাকা পাওয়ার আশায় পরবর্তীতে বাড়ি ও ব্যবসার ছক পটল করে রেখেছে । অথচ এখন জানতে পারলো, সে দশ লাখ টাকা পাচ্ছে না । তাকে তিন লাখ টাকায় সন্তুষ্ট থাকতে হবে । তাই চিন্তায় তার মাথায় হাত ! যদিও কিছু মানুষের অভিমত, সরকারের ভাণ্ডার চাঙ্গা হলে ভবিষ্যতে আরও কিছু টাকা পেলেও পেতে পারে । তবে তার কোনো গ্যারান্টি নেই । এই মুহূর্তে সরকারের কাছে ফাণ্ড নেই । যার জন্য সবার ক্ষেত্রে কাট-ছাট করে পেমেন্ট করার সরকারি সিদ্ধান্ত !
পটল বোনকে না জানিয়েই সরকারি প্রস্তাবে মত দিলো । ঝিঙে জানতে পারলে, একটা হুলস্থুল ঘটিয়ে ছাড়বে । সহজে সে মেনে নিতে পারবে না । প্রয়োজনে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দ্বারস্থ হবে । এখন ঝিঙের মুখে ইংরেজি ভাষার খই ফোটে । ঝিঙে কিছুতেই সরকারি কর্তাব্যক্তিদের অত সহজে ছেড়ে দেবে না । তাই বাধ্য হয়ে একরকম চুপি চুপি পটলের মত জানিয়ে সরকারি অফিস থেকে তিন লাখ টাকার চেক নিয়ে ব্যাঙ্কে জমা দিয়ে দিলো ।
ঝিঙের এখন রূপকের সঙ্গে খুব ভাব ভালবাসা । বাইকে চেপে নানান জায়গায় ঘোরাঘুরি । প্রতিদিন রূপকের বাইকে একবার ঘুরতে যাওয়া চাই । বেশীর ভাগ দিন তারা দুটিতে বিকেলে বের হচ্ছে । কেননা সন্ধ্যা রাত্রিতে রূপককে তার নিজের দোকানে বসতে হয় । সেই সময় রেস্টুরেন্টে অনেক ভিড় । কর্মচারীদের সাথে রূপক হাত লাগায় । মাঝে মাঝে ঝিঙে রূপকের সঙ্গে রেস্টুরেন্টে হাজির । খাবারের দোকানের কাজ কর্মে নিজেও হাত লাগায় । বিকেল থেকে রাত্রি ১০টা পর্যন্ত দোকানের ভিড় চোখে পড়ার মতো । খরিদ্দারেরা এখানে গুণমানসম্পন্ন খাবার ও উন্নত মানের পরিষেবা পায় । তা ছাড়া রূপক আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত । তার মার্জিত ব্যবহার । খাবারের কোয়ালিটির রক্ষার ক্ষেত্রে কোনোরকম ধানাই-পানাই তার না-পসন্দ ! যার জন্য ছোট্ট শহরে তার ব্যবসার রমরমা ।
রেজাল্ট বের হতে দেরী ! সেই কারণে ঝিঙের রূপকের সঙ্গে ঘোরাফেরার পর্যাপ্ত সময় । সকালে দাদার সঙ্গে প্লাটফর্মের দোকানে ঝিঙের ব্যস্ততা । ট্রেন ঢোকার সময় হলে পটলের দোকানে খরিদ্দারদের চাপ বাড়ে । সেই সময় ঝিঙে দাদার কাজে সহযোগিতা করে । দুপুরের রান্নার বাজার ঝিঙে এখন নিজের হাতে করে । কেননা দাদা সমস্ত কাজ একা হাতে সামলাতে পারে না । ঝিঙের কাজ হচ্ছে, ব্যাগে সবজির বাজার এনেই রান্না ঘরে ঢোকা । দুজনের খাবার বানানো হলে ঝিঙে ছোটে দাদার দোকানে । সেখানে থেকে দুজনে এক সঙ্গে ঘরে ফিরে দুপুরের আহার । তারপর পটল পুনরায় দোকানে ঢোকে । আর ঝিঙে সময় গুণতে থাকে, কখন রূপক এসে তাকে বাইকে চাপিয়ে তুলে নিয়ে ঘুরতে যাবে । ঘুরতে ঝিঙের খুব ভাল লাগে । বাইকের পেছনে চেপে লং ড্রাইভে যাওয়া তার খুব পছন্দ । যার জন্য হামেশাই রূপক ঝিঙেকে নিয়ে লং ড্রাইভে ছোটে ।
শনিবার দিন রূপক ঝিঙেকে জানিয়ে রাখলো, রবিবার সে কলকাতা যাবে । ব্যবসায়িক কিছু কাজকর্ম রয়েছে । সবগুলি কাজ আর্জেন্ট ! সুতরাং তাকে নিয়ে ঘুরতে যেতে পারবে না ।
রবিবারদিন দুপুরে খাওয়ার পর ঝিঙের মোচড়ানো শুরু । ঘুরতে যাওয়া বন্ধ । দাদা জানে, তার আদরের বোন রূপকের সঙ্গে ঘুরতে বের হয়ে গেছে । অথচ ঝিঙে বাড়িতে খাটে শোওয়া ! ভাবছে অতঃপর সে কী করবে ?
মন স্থির করলো, দাদার দোকানে গিয়ে দাদার কাজে সহযোগিতা করবে !
তখন বিকেল ৫টা । গুটি গুটি পায়ে স্টেশনের প্লাটফর্মে দাদার দোকানে হাজির । সে কী দেখছে ? স্বয়ং কুন্তী দাঁড়িয়ে । দুজনের হাতে আলু কাবলীর ঠোঙা । খাওয়ার সাথে সাথে তারা হাসি-মস্করায় মশগুল !
ঝিঙেকে দেখে তাদের চক্ষু চড়কগাছ ! দুজনের খাওয়া বন্ধ !
দাদাকে ঝিঙে চোখের ইশারায় খাওয়া চালিয়ে যেতে বললো ।
তারপর …!
 (চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here