আমার জন্মভিটে গৌরীনগর গ্রাম । মুর্শিদাবাদ জেলার ভরতপুর থানার আমলাই অঞ্চলের অন্তর্গত এই গৌরীনগর গ্রাম । অনুন্নত এই গাঁয়ে দীর্ঘদিন ধরে তপশীলি মানুষের বসবাস । ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ হওয়ার সময় গৌরীনগর গ্রামবাসীরা পূর্ব পুরুষদের ভিটেমাটি ছেড়ে নিঃস্ব ও ছিন্নমূল অবস্থায় এদেশে ঠাঁই নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন গৌরীনগর গ্রাম । মাথা গোঁজার ঠাঁই অতো সহজে ঘটেনি । নিঃসম্বল মানুষের অভিজ্ঞতা অতো মধুর নয় । এলাকাটা তখন ঘন জঙ্গলে ঘেরা । হিংস্র জন্তু-জানোয়ারের বসবাস । স্থানীয় মানুষদের গৃহপালিত পশু অর্থাৎ গরু, মহিষ, বাছুর, ইত্যাদির বিচরণ-স্থল ছিল ঐ জঙ্গল । সেখানের ঘন জঙ্গল কেটে গৌরীনগর গ্রাম । প্রথমে তাল পাতার ছাউনির ঘর । তারপর ধীরে ধীরে মানুষের স্থায়ী বসবাস । গ্রামটির পূর্বদিকে “বাবলা” নদী । ময়ূরাক্ষী নদী ও ভাগীরথী গঙ্গার শাখা নদী । নদী ভরা থাকে সর্বক্ষণ, আর তেমনি স্রোত । নদী পার হয়ে এক কিলোমিটার পথ হাঁটলে তবেই বাজারসৌ স্টেশনের দেখা মেলে । কলকাতার সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম একমাত্র রেলপথ ।
গৌরীনগর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আমার পড়াশুনা । সেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে টিউবওয়েল ছিল বটে, কিন্তু টিউবওয়েল চেপে স্কুলের বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েদের পক্ষে বালতি বোঝাই জল নিয়ে শৌচালয়ে ব্যবহার করা ছিল কষ্টসাধ্য । শুধু তাই নয়, মিড-ডে মিল রান্না করার মেয়েদের পক্ষে টিউবওয়েলের জল নিয়ে রান্না করা, থালা বাসন মাজাও ছিল ভীষণ কষ্টসাধ্য । বাচ্চাদের কষ্ট লাঘব করার জন্য আমার পরামর্শে, ভাই দীপেশ চন্দ্র রায় (বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ) আর্থিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলো এবং স্কুলের কর্তৃপক্ষের অনুমতিক্রমে পর্যাপ্ত পরিমানে পানীয় জলের ব্যবস্থার নিরিখে পাইপ লাইন বসিয়ে দিলো । এখন সাবমারসিবল পাম্পের সাহায্যে জল উপরের ট্যাঙ্কিতে তুলে সেই জল পাইপ লাইনের মাধ্যমে বিভিন্ন ক্লাসরুমে, মিড-ডে মিলের রান্না ঘরে পৌঁছে যাচ্ছে । গত ১৫ই মার্চ ছিল তার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন । আমরা তিন ভাই (দিলীপ, দীপেশ ও দিবাকর) সেখানে উপস্থিত ছিলাম । ট্যাপের মাধ্যমে জল পাওয়ায় ছাত্র-ছাত্রীরা ভীষণ খুশী । এমনকি স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকা, গ্রামবাসীরা জলের পাইপ লাইন বসানোর জন্য অত্যন্ত আনন্দিত । প্রধান শিক্ষক প্রাক্তন ছাত্র হিসাবে আমাদের কাজকে ভূয়সী প্রশংসা করলেন এবং বললেন, আমাদের কাজটা নাকি ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে উদাহরণস্বরূপ । উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গ্রামবাসীরাও উপস্থিত ছিলেন । সমগ্র অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করলেন প্রধান শিক্ষক মহাশয় ।
গৌরীনগর গ্রামের মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি গাঁয়ের রাস্তার সংস্কার । স্বাধীনতার ৭৬ বছর পরেও রাস্তাটি পাকা রাস্তায় পরিণত হয়নি । যারজন্য মানুষের দুর্ভোগের শেষ নেই । বর্ষাকালে এক হাঁটু কাদা । সম্ভবত দশ বছর আগে একবার মোড়ামের ব্যবস্থা হয়েছিল বটে, কিন্তু সেই মোরামের অবস্থা তথৈবচ । রাস্তা দিয়ে হাঁটা-চলা খুবই কষ্টসাধ্য । আমরা জানি, ভারত সরকারের প্রধান মন্ত্রীর সড়ক যোজনা প্রকল্প চালু অথচ তার ছিটেফোঁটার গন্ধ গৌরীনগর গ্রাম থেকে শত যোজন দূরে । বয়স্ক মানুষের চলাফেরায় হোঁচট খাওয়া, এখন গা-সওয়া ।
এছাড়া সামনে দিয়ে বয়ে চলেছে বিশাল “বাবলা” নদী । সেই নদী পার হয়ে এক কিমি হাঁটলে তবেই বাজারসৌ রেলস্টেশন । এমনকি উচ্চ বিদ্যালয়, কলেজ, বাজার হাট, ইত্যাদি । তাই নদী পারাপার তাঁদের নিত্য জীবনের অঙ্গ । অথচ সেই “বাবলা” নদীর উপর সেতু নেই । পারাপারের দুর্ভোগের জন্য প্রায় সময় নির্দিষ্ট ট্রেন পাওয়া যায় না, স্কুলে ঠিক সময়ে পৌঁছানো যায় না । তা ছাড়া রয়েছে নৌকায় পারাপারের বিপদের ঝুঁকি । নদীর মাঝখানে যেকোনো সময় নৌকা ডুবে যাওয়ার সম্ভাবনা । গৌরীনগর গ্রামের মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি “বাবলা” নদীর উপর ব্রিজ ।
এহেন রাস্তার পরিস্থিতির উন্নয়ন চেয়ে বরং বলা ভাল পাকা রাস্তার দাবি নিয়ে এবং “বাবলা” নদীর উপর সত্বর ব্রিজ নির্মাণের আর্জি নিয়ে গ্রামবাসীদের সাথে গতকাল (১৬-০৩-২০২৩) আমি ও দীপেশ মুর্শিদাবাদ জেলা শাসকের দ্বারস্থ হয়েছিলাম । মাননীয় জেলা শাসক মনোযোগ দিয়ে আমাদের কথা শুনেছেন । এমনকি কম্পিউটারের সাহায্যে রোড-ম্যাপ খুলে গৌরীনগর গ্রামের রাস্তার হালহকিকৎ নিজে উপলব্ধি করতে পারলেন । আর ব্রিজের প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারে তিনি সম্পূর্ণভাবে অবগত । পাকা রাস্তা এবং ব্রিজ নির্মাণের ব্যাপারে আশ্বাস দিয়ে তিনি বললেন, “দুটি ব্যাপারেই তিনি নজর দেবেন এবং সমস্যা সমাধানে তিনি যথেষ্ট আন্তরিক হবেন ।“