নির্ভীকতার আরেক নাম চন্দ্রশেখর আজাদ! : তন্ময় সিংহ রায়।

0
676

(শুভ জন্মদিবসে শ্রদ্ধাবনত চিত্তে স্মরণ!)

সাল ১৯১৪, সমগ্র বিশ্ব জুড়ে বেজে উঠলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামা!
ভারতের জাতীয়তাবাদী রাজনীতি তখন আংশিক নয়, বরং প্রায় সম্পূর্ণ নিমজ্জিত হতাশা’র গহীন অন্ধকারে!
ব্রিটিশ অধীনতা’র দাসত্ব শৃঙ্খল ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে তা থেকে মুক্তি পাওয়ার একান্ত উদ্দ্যেশ্যে এমত পরিস্থিতিতে, বিশ্বযুদ্ধের এই সুযোগকে উপযুক্তভাবে কাজে লাগিয়ে ভারতীয় বিপ্লবীরা নিরন্তর ও নিরলস চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, কিভাবে ভারতে একটি সুসংবদ্ধ ও জোরালো বিপ্লব করা সম্ভবপর হয়।
১৯০৭ সালে সুরাট অধিবেশনে জাতীয় কংগ্রেসের মতাদর্শ নরমপন্থী ও চরমপন্থী নাম ধারণ করে দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পৌঁছে যায় যথাক্রমে সুমেরু ও কুমেরু বিন্দুতে।
যেহেতু জাতীয় কংগ্রেস নামক সু-বৃহৎ বৃক্ষটির বীজ নিহিত ছিল নরমপন্থীতে, তাই চরমপন্থীরা কংগ্রেস থেকে হয়ে যান বিতাড়িত!
ফলস্বরূপ, রীতিমতন দুর্বল হয়ে পড়ে নরমপন্থী পরিচালিত জাতীয় কংগ্রেস।
এদিকে বিপিনচন্দ্র পাল, লালা লাজপৎ রায়, অরবিন্দ ঘোষ, কৃষ্ণকুমার মিত্র ও অশ্বিনীকুমার দত্ত প্রমুখ নেতৃবৃন্দের অভাবজনিত কারণে চরমপন্থীরাও নেতৃত্বহীনতার অভাবে হয়ে পড়েন দুর্বল ও হতাশাগ্রস্থ!
একদিকে সরকারের দমননীতি, অপরদিকে নেতৃত্বাভাব ও বার্ধক্যজনিত কারণে কর্মহীন হয়ে পড়া, সব মিলিয়ে চরমপন্থী আন্দোলন যেন অসহায়ভাবে মুখ থুবড়ে পড়ে ধূলিধূসর রাজপথে!
পরবর্তীকালে, সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ, লক্ষ্মৌ চুক্তি, হোমরুল লীগ ও রাওলাট আইন বিরোধী আন্দোলনের হাত ধরে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের রাজনৈতিক ইতিহাস এসে পৌঁছায় ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত, ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে অন্যতম কুখ্যাত এক গণনিধন ‘জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ড’-এর
দোড়গোড়ায়!
এখানে বলে রাখা ভালো, রাওলাট আইনের প্রতিবাদের উপরে ভিত্তি করে যে আন্দোলন সূচিত হয়, তারই চরম পরিণতি’র জীবন্ত দৃষ্টান্ত কিন্তু এই জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ড!
লেফটেন্যান্ট গভর্নর মাইকেল ও’ ডায়ার এর স্বৈরাচারী শাসনের ফলস্বরূপ পাঞ্জাবের অমৃতসর সেসময় যথার্থই পরিণত হয় জ্বলন্ত এক অগ্নিকুন্ডে!
শুধু অমৃতসরেই তা কিন্তু থাকেনি সীমাবদ্ধ, এরপর পাঞ্জাবের আরো পাঁচ-পাঁচটি জেলাকে বন্দী করা হয় সামরিক আইন বলের ঘেরাটোপে।
এ পরিস্থিতিতে, খিলাফৎ আন্দোলন চিত্রে মহাত্মা গান্ধী’র রেটিনায় গঠিত হয় হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের সম্ভাবনার এক স্বচ্ছ
প্রতিবিম্ব, যা তিনি আগামী ১০০ বছরেও আর আসবেনা মনে করে, জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে ইংরেজ সরকারের বিরূদ্ধে কর্মসূচি গ্রহণ করেন অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের।
সে বছরেই অর্থাৎ ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে তিনি প্রতিষ্ঠিত হন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বে।
একদিকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের নির্মম আঘাতে দেশবাসীর বিশেষত অর্থনৈতিক সংকট চরমে!
ওষুধ, চাল, ডাল, চিনি, কাপড় প্রভৃতি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মূল্যের সূচক চুড়ান্ত ঊর্ধ্বমুখী। কৃষিজাত দ্রব্যও অতি স্বল্প মূল্যে মহাজনদের কাছে বিক্রি করতে বাধ্য হয় কৃষকরা। বৃদ্ধি পায় শিল্পদ্রব্যের মূল্য কিন্তু শ্রমিকের মজুরী সেখানেই হয়ে থাকে স্ট্যাচু!
অন্যথায়, প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালে ভারতে ব্রিটিশদের বিভিন্ন পণ্যের আমদানী বন্ধ হওয়ায় সরকার ভারতীয়দের শিল্পবিস্তারের ক্ষেত্রে উৎসাহী হলেও, যুদ্ধ শেষে নানান বিধিনিষেধ আরোপ করা হলে, সেগুলির উপরে এবং নতুন শিল্প স্থাপনে সৃষ্টি করা হয় যথাসাধ্য বাধা’র! ফলতঃ, জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডে ঘৃতাহুতি চিত্তে ভারতীবাসী হয়ে ওঠেন আরো বেশি ক্ষুব্ধ!
সব মিলিয়ে, সমকালীন আন্তর্জাতিক এ হেন পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে অসহযোগ আন্দোলনের পটভূমি যেন হয়েই যায় তৈরি।
এমনই এক ক্রান্তিকালীন মুহুর্তে, মধ্যপ্রদেশের আলিরাজপুর জেলার ভাওরা গ্রামের এক ১৫ বছরের এক অকুতোভয় তরুণ বিপ্লবী জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ড দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়ে অংশগ্রহণ করেন অসহযোগ আন্দোলনে।
সংস্কৃত ভাষায় গভীর জ্ঞান অর্জনের উদ্দ্যেশ্যে তাঁকে বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানো হলে, সেই বছরই অর্থাৎ ১৯২১ সালে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন এই আন্দোলনে।
স্বাধীনতা সংগ্রামের আত্মবিসর্জনকে কেন্দ্র করে পরবর্তীতে যুদ্ধে দক্ষতা বৃদ্ধি’র প্রশিক্ষণের জন্যে তিনি বেছে নিয়েছিলেন ঝাঁসি থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরের একটি গোপন ও নিরাপদ স্থানকে। ঝাঁসিতে থাকাকালীন পণ্ডিত হরিশঙ্কর ব্রহ্মচারী ছদ্মনাম গ্রহণ করে গোপনে প্রশিক্ষণ চালানোর মধ্যে দিয়ে তিনি তাঁর গোষ্ঠীর সদস্যদের এ প্রকারেই বৃদ্ধি করেছিলেন রণকৌশল।
ব্রিটিশ রাজত্বকালে তিনি কখনই পুলিশ কর্মকর্তাদের হাতে জীবিত ধরা পড়বেন না, এমন দৃঢ়সংকল্পের দুর্ভেদ্য পোশাক পরিহিত এই সিংহপুরুষকে গ্রেপ্তার করে একবার এক ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে আনা হলে ম্যাজিস্ট্রেট চন্দ্রশেখরকে প্রশ্ন করে বসেন, ‘কি তোমার পরিচয়?’
সগর্বে ‘আজাদ’ হিসেবে তিনি নিজেকে
পরিচয় দেন, যার অর্থ ‘মুক্ত’ আর সেইদিন থেকেই তিনি পরিচিতি অর্জন করেন ‘চন্দ্রশেখর আজাদ’ নামে।
অবশেষে, এলাহাবাদের আলফ্রেড পার্কে পুলিশবাহিনী’র চক্রব্যূহকে মূল্যহীন ও তুচ্ছ প্রমাণিত এবং আত্মসম্মানকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেই ১৯৩১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি, বিপ্লবী ভগৎ সিংয়ের আদর্শ গুরু হিসেবে পরিচিত এই বীর স্বাধীনতা সৈনিক নিজের শেষ বুলেটটি দিয়ে নিজেকে উৎসর্গ করে লুটিয়ে পড়েন অবিভক্ত ভারত মায়ের বুকে।

ফ্লিপ কার্ড অথবা অ্যামাজন-এ অর্ডারের মাধ্যমে স্বাধীনতা আসেনি, এসেছে দীর্ঘ এক কঠিন সংগ্রাম ও রক্তবন্যায় ভেসে, এ আমরা সবাই কম-বেশি জানি কিন্তু ওইটুকুই ব্যাস!
এরপর জানা’র অ্যাপ্লিকেশন’টা অক্সিজেনের অভাবে ধুঁকে ধুঁকে এক সময় স্থান পায় শশ্মান কিংবা কবরে!
রাজমিস্ত্রি আজও গেঁথে চলেছে দেওয়াল কিন্তু, বোধকরি সিংহভাগ অভিভাবকই তাঁদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের দেওয়ালে এনাদের আদর্শ আজ আর গাঁথেন না, আজ শুধুই মুখস্থ করা হয় এনাদের, ফলে ঘরে ঘরে জন্ম নিচ্ছে আত্মকেন্দ্রিক ও শান্তিপ্রিয় সন্তান!
বিস্মৃতি’র অতল গহ্বরে কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছেন এ সমস্ত গর্বিত বঙ্গ মায়ের বীর সন্তানরা! ইতিহাসও যেন আজ আর চাইছে না এনাদের সাথে কোনপ্রকার সম্পর্ক রাখতে!
কেমন যেন লন্ড-ভন্ড ও অগোছালো এ সময়!
মাঝে মধ্যেই মনে হয় মনুষ্যত্ব’টা তর্জনী উঁচিয়ে প্রশ্ন করে বসে, এ হেন হোমোস্যাপিয়েন্স-এর চেয়ে আমার ইজিপ্টোপিথেকাস ছিল অনেক ভালো!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here