প্রভুপাদ বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী— এক আশ্চর্য মহাজীবন কথা (পর্ব- ৪) : রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক।

0
360

কলকাতায় ফিরে এলেন শ্রীবিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী। সংস্কৃত কলেজে ক্লাস শুরু হয়েছে। অনুপস্থিত থাকলে নিজের সমস্যা হবে সিলেবাস শেষ করতে । কিন্তু, ভাগ্য যে এমন বিড়ম্বনা করবে তা কে জানত ! তিনি যে সহপাঠীর সঙ্গে এক ঘরে থাকতেন, সেই সহপাঠী বন্ধু তাঁর বাক্স থেকে টাকা চুরি করে জুয়া খেলতে চলে যান। আর যথারীতি ঠকবাজ জুয়াড়িদের কাছে সব টাকা হেরে বসেন। বিজয়কৃষ্ণ মহা বিপদে পড়লেন।সেই বন্ধু টাকা চুরি করে কোথায় যে গা ঢাকা দিয়েছেন খোঁজ পেলেন না তাঁর। এদিকে অন্নসংস্থানের উপায় নেই । প্রায় অনাহারে অতিশয় কষ্টে দিন কাটতে থাকলো বা বলা ভাল দিন যেন আর কাটতেই চায় না কম খাওয়া পেটে। জানতে পারলেন একজন সহৃদয় ব্যক্তি আছেন তিনি নাকি বেশ কিছু দুঃস্থ ছাত্রদেরকে নিজের ভবনে থাকতে দিয়েছেন। যদি তিনি কিছু সাহায্য করেন—এই আশা নিয়ে সেই ব্যক্তির দ্বারস্থ হলেন বিজয়কৃষ্ণ । কারণ, গৃহে তিনি ফিরবেন না, যেভাবে যত কষ্টই হোক সংস্কৃত কলেজে তিনি পড়বেনই। পড়াশোনায় প্রবল ইচ্ছে তাঁর। অথচ ,সেই ব্যক্তিও টাকা দিতে রাজি হলেন না। কারণ, যাদের তিনি গৃহে থাকতে দিয়েছিলেন, তারা নাকি দুর্ব্যবহার করেছে তাঁর সাথে। তাতে তাঁর এতটাই মনে লেগেছে যে তিনি স্থির করেছেন কখনো কোন‌ ছাত্রকে থাকতেও দেবেন না আর সাহায্যও করবেন না। । তিতিবিরক্ত হয়ে এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণ । অগত্যা মলিন মুখে, মহাদুঃখী মনে ফিরে আসতে হল বিজয়কৃষ্ণকে।

মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে যদি সাহায্য চাওয়া যায়, তাহলে কেমন হয়! তাহলে হয়তো এ সমস্যার সুরাহা হতে পারে! কারণ , তিনি তো ভালো মনের মানুষ! এই মনে করে বিজয়কৃষ্ণ নিজের সমস্ত কথা একটি পত্রে লিখে সেটি নিয়ে অনুমতি যোগাড় করে হাজির হলেন জোড়াসাঁকোয় দেবেন্দ্রনাথের সামনে। দেবেন্দ্রনাথ আবেদনপত্রটি হাতে নিয়ে ছিঁড়ে ফেলে দিলেন না পড়েই । অন্য কেউ এ কাজ করলে তার ওপর নিশ্চয়ই খুব রাগ হত বিজয়কৃষ্ণের। কিন্তু বগুড়ার সেই তিন ব্যক্তির মুখে দেবেন্দ্রনাথ সম্পর্কে এত সুখ্যাতি শুনেছেন যে তাতেই মন মুগ্ধ হয়েছিল তাঁর (দেবেন্দ্রনাথের) প্রতি। আসলে বেশ কিছু সাহায্যপ্রার্থী ব্যক্তি টাকা নিয়ে এমন প্রতারণা করেছে যে দেবেন্দ্রনাথ বীতশ্রদ্ধ হয়ে গেছেন এসব ব্যাপারে। তিনি সাহায্য করার বিষয়ে আর কোন কথা শুনছিলেন না। পাছে মন আবার নরম হয়ে যায় সেসব জেনে বা পড়ে তাই সাহায্যের বিষয় শুনেই না পড়ে ছিঁড়ে ফেলেছিলেন পত্রটি।

কলকাতায় অন্যান্য আত্মীয়বর্গ বা বন্ধুরা যে কেউ নেই, তা নয়। কিন্তু, এমনটাই তিক্ত অভিজ্ঞতা হল একয়দিনে যে পাছে তাঁরা বিরক্ত হন এই আশঙ্কায় আর তাঁদেরও দ্বারস্থ হলেন না বিজয়কৃষ্ণ । দিন পেরিয়ে রাত হেয়েছে, আজ একটি পয়সাও নেই যে তা দিয়ে কিছু কিনে খাবেন। উপবাসক্লীষ্ট মুখ নিয়ে বসেছিলেন পথের ধারে এক বেঞ্চিতে । একজন সহৃদয় ভদ্রলোক তাঁর মলিন মুখ দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, “বাছা, তোমার কি কিছু খাওয়া হয়নি সারাদিনে আজ?” মাথা নেড়ে ‘না’ জানালেন বিজয়কৃষ্ণ। তখন ভদ্রলোক একটি সিকি বের করে বিজয়কৃষ্ণের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন,”যাও ! এই সিকি দিয়ে কিছু কিনে খাও ।” এতটাই ক্ষুধাতুর তখন বিজয়কৃষ্ণ যে হাত পেতে সিকিটি নিয়ে নিলেন ও ধন্যবাদ জানিয়ে খাবারের দোকানের দিকে রওনা হলেন। হঠাৎ পথে সেই টাকাচোর বন্ধু তাঁর সামনে এসে দাঁড়ালেন , বললেন, “আমায় তুমি ক্ষমা করে দাও,ভাই। আমার ভুল হয়ে গেছে। ওভাবে না বলে তোমার টাকা নিয়ে নেওয়া উচিৎ হয়নি। ভেবেছিলাম জিতে এসে ফেরৎ দিয়ে দেব। কিন্তু, ……” এই বলে জুয়াড়িদের কাছে কি ভাবে প্রতারিত হয়েছেন তা বলতে শুরু করলেন। বিজয়কৃষ্ণ তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,”তুমি কি সারাদিনে কিছু খেয়েছো, বন্ধু ?” ‘না’ জানালেন সহপাঠী। বিজয়কৃষ্ণ বললেন, “তাহলে চলো দু’জনে মিলে খাবার খাই। আমার কাছে একটা সিকি আছে । পুরোনো ধূলো ঘেঁটে আর কাজ নেই। আগামী দিনের কথা ভাবি। ভাগ্যে ছিল হয়ে গেছে।” বন্ধুটি বিজয়কৃষ্ণের বড় মন দেখে বিস্মিত হয়ে গেলেন । শ্রদ্ধায় ভরে গেল মন তাঁর বিজয়কৃষ্ণের প্রতি। আর , বৃথা বাক্যব্যয় না করে তাঁরা পা বাড়ালেন খাবারের দোকানের দিকে। পরিতৃপ্তিতে পেট ভরে আহার করে অন্তরে শীতলতা ফিরে পেলেন দু’জনাই। এরপর দু’জনে মিলে দেশের বাড়ি থেকে টাকা যোগাড় করে এনে একসাথেই ঘর ভাড়া করে থাকতে শুরু করলেন।

সংস্কৃত কলেজে অধ্যয়ন মনোযোগ সহকারে চলতে থাকল বিজয়কৃষ্ণের। হঠাৎ একদিন মনে পড়লো বগুড়ার বন্ধুদের পরামর্শের কথা।আর, তাই তিনি স্থির করলেন আগামী বুধবারে জোড়াসাঁকোয় ব্রাহ্মসমাজের যে সভা হবে তাতে যোগদান করে দেবেন্দ্রনাথের ভাষণ শুনবেন।

সভায় উপস্থিত হলেন বিজয়কৃষ্ণ। ব্রাহ্মসমাজের প্রার্থনা সংগীত শ্রবণ করে তাঁর চিত্ত ভরে গেল । মনে হতে থাকলো একেই বুঝি বলে স্বর্গীয় পরিবেশ ! এত পবিত্র ! এত শান্ত ! আর যখন দেবেন্দ্রনাথের ভাষণ শুনলেন তখন তো ব্রাহ্মসমাজের আদর্শের প্রতি শ্রদ্ধায় দ্রবীভূত হয়ে গেল তাঁর হৃদয়। মনে মনে ভাবলেন, “আমি তো ধর্মকে এভাবেই দেখতে চাই।” এতদিন ধরে নাস্তিকতার প্রবল প্রতাপ তাঁর যে মনকে সমাচ্ছন্ন করে রেখেছিল, সেই মন যেন আজ এই উপাসনা-প্রার্থনার স্নিগ্ধ-শান্ত-আস্তিক্যবাদ অনুভূতিতে বাজেয়াপ্ত হল। তিনি পূর্বের ঈশ্বরবিশ্বাসী অন্তরের শান্তি ফিরে পেলেন । তাঁর মন মরুভূমি অকস্মাৎ যেন মরুদ্যানে পরিণত হল। রঙহীন হৃদয় তাঁর আবার রঞ্জিত হল যেন। ঈশ্বরের অস্তিত্ব বোধের চেতনা ফিরে পেলেন বিজয়কৃষ্ণ।

——–ক্রমশঃ
——ভক্তকৃপাপ্রার্থিনী
রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here