সুন্দরবনে খলসি ফুলের সুস্বাদু মধু সংগ্রহে সুন্দরবনের গভীর জঙ্গলে মৌলেরা,চিন্তায় পরিবার ।

0
1441

সুন্দরবনে খলসি ফুলের সুস্বাদু মধু সংগ্রহে সুন্দরবনের গভীর জঙ্গলে মৌলেরা, চিন্তায় পরিবার ।

সুভাষ চন্দ্র দাশ, ক্যানিং :- নাওয়া-খাওয়া ভুলে দলবদ্ধ ভাবে প্রত্যন্ত সুন্দরবনের গভীর জঙ্গলে মধু সংগ্রহের জন্য ব্যস্ত মৌলেরা(মধু সংগ্রহকারী)।হাতে সময় মাত্র ১৪ দিন।নদীর স্রোতের মতো বয়ে চলেছে অমূল্য সময়। সেই অমূল্য সময় কে নষ্ট করতে রাজী নয় সুন্দরবনের প্রত্যন্ত এলাকার মধুসংগ্রহকারী মৌলেরা,যাদের জীবন জীবিকার জন্য একমাত্র সুন্দরবন জঙ্গলের মধু আর নদী খাঁড়ীতে মাছ কাঁকড়া ধরেই দিন গুজরান করতে হয়। দ্বিতীয় কোন উপায় না থাকায় তাই বাধ্য হয়েই বিখ্যাত বাদাবন সুন্দরবন জঙ্গলের হিংস্র বাঘ কিংবা নদীতে কুমীরের ভয় উপেক্ষা করে মধু,কাঁকড়া সংগ্রহ করতে যেতেই হয়। তাই মধু সংগ্রহ করতে নির্দিষ্ট নিয়ম মেনেই সুন্দরবনে গভীর অরণ্যে পাড়ি দিয়েছেন মৌলেরা।মূলত মধুমাস বলা হয় এপ্রিল মাসকে।এই সময় সূদূর  হিমালয় থেকে কোটি কোটি মৌমাছি আসে এই পৃথিবী খ্যাত বৃহত্তম ব-দ্বীপ ম্যানগ্রোভ অরণ্য সুন্দরবন জঙ্গলে।এই মৌমাছি চেহারায় বেশ অনেকটা বড় আকৃতির। প্রায় এক দেড় ইঞ্চি লম্বা হয়।এই পাহাড়ী মৌমাছির নাম ডাঁশ(Rock Bee)।এরা স্থানীয় মাছি কিংবা মৌমাছি কে অনায়াসেই আক্রমণ করে মেরে ফেলতে সক্ষম এবং মেরেই ফেলে।

“খলসি” গাছের ফুল ও এই সময় ফোটে। সেই ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করার জন্য কোটি কোটি মৌমাছির আগমন ঘটে সূদূর হিমালয় থেকে সুন্দরবনের গহীন জঙ্গলে। আবার সমগ্র বিশ্বে যত বাদাবন জঙ্গল আছে তার মধ্যে অন্যতম একমাত্র সুন্দরবনের জঙ্গলে প্রায় ৪০০ প্রজাতির গাছগাছালি জন্মায়। তার মধ্যে অন্যতম এই খলসি গাছও পৃথিবীর একমাত্র সুন্দরবন জঙ্গলে জন্মায়। পৃথিবীর অন্য কোন জঙ্গলে এই খলসি গাছ জন্মায় না।এই খলসি ফুলের গন্ধ সুগন্ধি যুক্ত বড়ই মধুময়।

সমগ্র সুন্দরবনের ১৯টি ব্লক।এরমধ্যে দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলায় ১৩টি এবং উত্তর ২৪ পরগণা জেলায় ৬ টি।আবার বনবিভাগের নিয়ম অনুযায়ী ২২টি ব্লক(বন্যপ্রাণী দ্বীপ)এর ১১৫ টি কম্পর্টমেন্ট(ঘন জঙ্গল এলাকা) মধু পাওয়া যায়।চলতি মধুর সিজন এপ্রিল মাস। আর সেই কারণে বনদফতরে বৈধ অনুমতি নিয়েই মৌলেদের ৪৩ টি টীম মধু সংগ্রহের জন্য সুন্দরবনের জঙ্গলে গিয়েছে। প্রতিটি টীম চারজন ও পাঁচ করে রয়েছে।অন্যান্য ফুলের মধু সামান্য হলেও তিতা হলেও খলসি ফুলের মধু অত্যন্ত সুস্বাদু হয়। বনদপ্তর আবার মৌলেদের কাছে সংগৃহিত মধু কিনে নিয়ে শোধন করে “মৌবন” নামে বাজারে বিক্রি করে।
উল্লেখ্য করোনা তান্ডবে ২০২০ সালে বনদফতর কোন মৌলে কে অনুমতি না দেওয়ায় মধু সংগ্রহ হয়নি। পরবর্তী ২০২১ সালে অল্প সংখ্যক মৌলে বনদফতরের বৈধ অনুমতি নিয়ে মধু সংগ্রহের জন্য সুন্দরবন জঙ্গলে গেলেও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে তেমন ভাবে মধু সংগ্রহ হয়নি। মাত্র ৩৫০০ কেজি মধু সংগ্রহ হয়েছিল।
সুন্দরবন ব্যাঘ্র প্রকল্পের ডেপুটি ফিল্ড ডিরেক্টর জোন্স জাস্টিন জানিয়েছেন ‘চলতি বছর বাঘের আক্রমণে প্রাণহানির সংখ্যা বেড়েছে। আর সেই কারণে মধু সংগ্রহ করতে গিয়ে মৌলেদের প্রাণহানির ঘটনা ঘটলে মাথা পিছু ১ লক্ষ টাকা বিমার ব্যবস্থা করেছে বনদফতর। ‘৯ এপ্রিল থেকে ১৫ মে পর্যন্ত মৌলেরা জঙ্গলে মধু সংগ্রহ করতে পারবেন।সংগৃহিত মধু ২০০ টাকা কেজি প্রতি দরে  কিনে নেবে ওয়েষ্ট বেঙ্গল ফরেষ্ট কর্পোরেশন। সেই মধু সংশোধন করে প্যাকেজিং হবে। পরে তা ‘মৌবন’ নামে খোলা বাজারে বিক্রি করবে।তিনি আরো বলেন খলসি ফুল ভালো মতো ফুটেছে। ফলে চলতি বছর ১০ হাজার কেজির উপর মধু সংগ্রহ হবে বলে আশা করা যায়।’

উল্লেখ্য ডাঙায় বাঘ আর জলে কুমীর এই বিপদ সঙ্কুল প্রত্যন্ত সুন্দরবনের জঙ্গল থেকে মধু(সুন্দরবনের তরল সোনা)সংগ্রহ অন্যতম প্রধান জীবিকা মৌলিদের। গ্রামবাসী,জেলে-মৌলিরা ৫-৬ জনের এক একটি দল পৃথক ভাবে জঙ্গলে মধু সংগ্রহ করতে। এই কাজে যাওয়ার আগে গ্রামে সাড়ম্বরে “বনদেবী”(বনবিবি),দক্ষিণরায় ও মা নারায়ণীর’র পূজো, “দুখে যাত্রার”র আয়োজন করেন। দক্ষিণরায়ের ডেরা থেকে সুস্থ,অক্ষত অবস্থায় ফিরে আসার জন্য গৃহের মহিলারা উপবাস করে স্নান করে সুচিবস্ত্রে দেবীর কাছে কান্নাকাটির পর মানত করে হাতে পুরোহিতকে দিয়ে লাল সুতোর মাদুলী-তাবিজ-কবচ বাঁধিয়ে নেয়। জঙ্গলের উদ্দেশ্যে রওনা কিংবা বিদায় বেলায় চোখের জল ফেলা নিষিদ্ধ।সংসারের আপন প্রিয়জন জঙ্গল থেকে কবে বাড়ী ফিরবেন সেই অপেক্ষায় নদীর পাড়ে পথ চেয়ে বসে থাকেন পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা।বাড়ীতে চলে শোকের ছায়া,পালিত হয় অশৌচ।বাড়ীতে দিনের বেলায় রান্না হয় না,পাশাপাশি কাপড়কাচা,বাড়ীতে ঝাঁট দেওয়া এমন কি বাড়ীতে কোন আত্মীয় এলে তাকে বসতে জায়গা দেওয়া,জল খেতে দেওয়া নিষিদ্ধ।বাড়ীতে একমাত্র দেবীর পূজো অর্চনা ছাড়া সমস্ত রকম আমোদ-প্রমোদ আনন্দ বন্ধ থাকে।এছাড়াও বাড়ী গৃহবধুরা শাঁখা,সিঁদুর পরাও বন্ধ রাখেন। বাড়ীর প্রিয়জন মানুষটি বাড়ী ফিরলেই ঢাকঢোল পিটিয়ে শুরু হয় আনন্দ উৎসব। বাড়ীর লোকজন জঙ্গলে যাওয়ার পর থেকেই যতদিন না তারা  সুন্দরবনের গহীন জঙ্গল থেকে বাড়ীতে  ফিরবে ততদিন পর্যন্ত বাড়ীর মহিলারা প্রতি শুক্রবার সূর্য্যোদয় থেকে সূর্য্যাস্ত পর্যন্ত নির্জলা উপোস থেকে সন্ধ্যায় বনবিবি মায়ের পুজো দিয়ে আতপচালের সিদ্ধ ভাত খেয়ে থাকেন।

ঘরের লোক জঙ্গল থেকে বাড়ীতে ফিরলে জাঁকজমক করে বাড়ী কিংবা জঙ্গলের ভিতরে গিয়ে বনবিবি দেবীকে পূজো করা হয় ক্ষীর দিয়ে।
অনেক মৌলি আবার বাঘের মুখ বাঁধা মন্ত্র জানা গুনীণকে সাথে করে নিয়ে যান।বনের উদ্দেশ্যে যাওয়ার আগে পাঁচ পীর(মানিক পীর,দরিয়া পীর,সত্য পীর,গোরাচাঁদ পীর,কাউর পীর) এর নামে “বদর বদর” ধ্বনি দিয়ে সকল দেব-দেবীর আশীর্বাদ নেন।

গভীর জঙ্গলে মধুর চাক কাটার সময় নদীতে স্নান করে ভিজে কাপড়ে কোন এক গাছের তলায় গরাণ পাতার থালা তৈরী করে গুড়ের বাতাসা দিয়ে পূজা করেন।এরপর সঙ্গে থাকা গুণীন জঙ্গলের নির্দিষ্ট এলাকা বেঁধে দেন(যেখানে কোন বাঘ প্রবেশ করতে পারবে না),তারপর শুরু হয় উড়ন্ত মৌমাছির গতি বিধি লক্ষ্য করে মৌচাক খোঁজার পালা।আবার পরষ্পর সঙ্গীরা নিরাপদে আছে কি না তা জানান দিতে কিছুক্ষণ পর পর “ক—–ক——ক—–” ধ্বনি শব্দে নিজেদের খেয়াল রাখে।কোন প্রকার সাড়া-শব্দ না পাওয়া গেলেই ধরে নেওয়া হয় সঙ্গীকে বাঘে নিয়ে গেছে কিংবা কোন বিপদে পড়েছে। বেগতিক বুঝে মুহুর্তে কাজ বন্ধ করে দেন সবাই।এলাকাটি খুবই বিপজ্জনক বোঝাতে লাল গামছা কোন এক গাছে বেঁধে নিশানা করে দিয়ে ফিরে আসে গ্রামে।আবার অনেক সময় সঙ্গীরা লাঠীসোঁটা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন বাঘের উপর।বাঘের সাথে লড়াই করে সঙ্গীকে উদ্ধার করেও আনেন।এমন ঘটনার কথা শুনে অন্যান্য মৌলিরা সেইদিন মধু সংগ্রহের কাজ বন্ধ করে দেন। নৌকায় ফিরে রাতেই বনবিবি দেবী ও দক্ষিণরায় ও মা নারায়ণী’র নামে বন্দনা করে সকল মৌলের মঙ্গল কামনা জানিয়ে গাছের পাতায় মধুর নৈবেদ্য সাজিয়ে পূজো করেন।পর দিন আবার শুরু হয় মধুর চাক খুঁজে মধু সংগ্রহ করা।

এই সুন্দরবনের জলজঙ্গলের উপর নির্ভর করে এই সব মৎস্যজীবী পরিবার গুলি তাই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সুন্দরবনের বিখ্যাত সুস্বাদু মধু সংগ্রহের জন্য প্রতি বছর একবারই অনুমতি মেলে।সেই এপ্রিল মাসে একবারের জন্য ১৪ দিনের বনদফতরের অনুমতি নিয়ে জঙ্গলে প্রবেশ করতে পারেন মৌলেরা। সেই সুযোগ হাতছাড়া না করে অন্যান্য বছরের ন্যায় শুক্রবার সন্ধ্যায় গোসাবা ব্লকের পাখিরালয়,রাঙাবেলিয়া গ্রামের লক্ষ্মী ভক্তা, অরুণ ভক্তা,সুধীন্দ্রনাথ মন্ডল, অমল মন্ডল,উত্তম বারুইরা মধু সংগ্রহের জন্য রওনা দিলেন গহীন নদীনালা অরণ্যে ঘেরা বৃহত্তম ব-দ্বীপ ম্যানগ্রোভ বাদাবন সুন্দরবনের গহীণ জঙ্গলে।

গহীণ জঙ্গল থেকে কবে ফিরবে নিকট আত্মীয় পরিবার পরিজনেরা সেই অপেক্ষা চাতকের মতো অধীর আগ্রহে পথ চেয়ে বসে অষ্টমী মন্ডল,সোনা বারুই সহ অন্যান্যরা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here