
বিজ্ঞান মানেই আবিষ্কার, অনুসন্ধান আর বিস্ময়। এই বিস্ময়ের জগতে বাস্তবের ছোঁয়া পেতে চাইলে কলকাতার সায়েন্স সিটি ভ্রমণ এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা।
ভারতের বৃহত্তম বিজ্ঞানভিত্তিক থিম পার্কগুলির মধ্যে অন্যতম এই সায়েন্স সিটি শুধু শিক্ষার্থীদের নয়, প্রত্যেক বয়সের মানুষের মনকে টানে তার অনন্য প্রদর্শনী, প্রযুক্তি এবং বিনোদনের মেলবন্ধনে।
️ প্রতিষ্ঠার ইতিহাস ও উদ্দেশ্য
সায়েন্স সিটির উদ্বোধন হয় ১ জুলাই ১৯৯৭ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রী আই. কে. গুজরাল-এর হাতে। এটি নির্মিত হয়েছিল ন্যাশনাল কাউন্সিল অব সায়েন্স মিউজিয়াম (NCSM)-এর তত্ত্বাবধানে।
এর মূল উদ্দেশ্য ছিল—বিজ্ঞানকে সাধারণ মানুষের কাছে সহজ, আকর্ষণীয় এবং মজাদার করে তোলা।
আজ এটি শুধু কলকাতার নয়, সমগ্র ভারতের অন্যতম জনপ্রিয় বৈজ্ঞানিক পর্যটনকেন্দ্র।
অবস্থান ও যাতায়াত
সায়েন্স সিটি অবস্থিত কলকাতার EM Bypass-এ, পার্ক সার্কাস থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার দূরে।
- নিকটতম মেট্রো স্টেশন: সায়েন্স সিটি (EM Bypass) বা সল্টলেক স্টেডিয়াম।
- বাস/ট্যাক্সি: শহরের যে কোনো প্রান্ত থেকে সরাসরি সায়েন্স সিটির বাস পাওয়া যায়।
- সময়সূচি: প্রতিদিন সকাল ৯:০০ থেকে সন্ধ্যা ৮:০০ পর্যন্ত খোলা থাকে।
- প্রবেশমূল্য: প্রাপ্তবয়স্ক ₹৭০, শিশু ₹৪০ (বিশেষ প্রদর্শনীর জন্য আলাদা টিকিট)।
️ স্থাপত্য ও পরিকাঠামো
সায়েন্স সিটির স্থাপত্য একেবারে আধুনিক এবং ভবিষ্যতমুখী।
বৃহৎ ডোম থিয়েটার, বিশাল প্রদর্শনী হল, উদ্ভাবনী বাগান, রোপওয়ে, ডাইনোসর পার্ক, ও ইন্টার্যাকটিভ সায়েন্স এক্সপেরিমেন্ট জোন—সব মিলিয়ে এটি এক পূর্ণাঙ্গ বিজ্ঞান নগর।
ভবনের বাইরের অংশে ধাতব কাঠামো ও কাচের ব্যবহার ভবিষ্যতের বিজ্ঞান নগরীর প্রতীক বলে মনে হয়।
মূল আকর্ষণসমূহ
১️⃣ স্পেস থিয়েটার (Space Theatre)
এটি সায়েন্স সিটির প্রাণকেন্দ্র।
একটি বিশাল গম্বুজাকৃতি থিয়েটার, যেখানে 3D ও 360° ডোম প্রজেকশন সিস্টেমে মহাকাশ, গ্রহ, নক্ষত্র এবং মহাবিশ্বের রহস্য তুলে ধরা হয়।
“Cosmic Voyage” ও “Dynamic Earth”-এর মতো শো দর্শকদের এক অনন্য মহাকাশ সফরের অভিজ্ঞতা দেয়।
2️⃣ ডাইনোসর পার্ক
প্রবেশ করলেই দেখা যায় জীবন্ত আকারের রোবটিক ডাইনোসর, যেগুলো চলাফেরা করে ও গর্জন করে।
শিশুদের কাছে এটি সবচেয়ে জনপ্রিয় স্থান। এখানে ডাইনোসর যুগের জীবজগত সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে আকর্ষণীয় ভিজ্যুয়াল প্রদর্শনের মাধ্যমে।
3️⃣ ইভোলিউশন পার্ক (Evolution Park)
এই অংশে পৃথিবীতে জীবনের বিকাশের গল্পটি তুলে ধরা হয়েছে।
প্রাচীন সমুদ্রের প্রাণী থেকে শুরু করে মানুষ পর্যন্ত, প্রতিটি ধাপকে অ্যানিমেটেড ডায়োরামা-র মাধ্যমে জীবন্ত করে দেখানো হয়েছে।
এক কথায়, এটি জীববিজ্ঞানের এক চলমান পাঠশালা।
4️⃣ ডায়নামোশন হল (Dynamotion Hall)
এই অংশটি দর্শনার্থীদের সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করে।
এখানে দর্শকরা নিজেরাই বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা করতে পারে—
যেমন আলো, শব্দ, চৌম্বক, বায়ুচাপ, ভারসাম্য, গতি প্রভৃতি নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট।
এখানে বিজ্ঞান শুধু পড়া নয়—বিজ্ঞানকে অনুভব করার সুযোগ।
5️⃣ মারিটাইম সেন্টার (Maritime Centre)
এই অংশে ভারতীয় সামুদ্রিক ইতিহাস, জাহাজ নির্মাণ প্রযুক্তি এবং নৌবাহিনীর বিবর্তন তুলে ধরা হয়েছে।
একটি বিশাল জাহাজের মডেল এবং প্রাচীন মানচিত্র দেখে মনে হয় যেন আপনি সমুদ্রযাত্রার জগতে ঢুকে পড়েছেন।
6️⃣ রোপওয়ে ও সায়েন্স এক্সপ্রেস
রোপওয়েতে চড়ে পুরো সায়েন্স সিটিকে আকাশ থেকে দেখা যায়।
এছাড়াও আছে Science on a Sphere নামে একটি ডিজিটাল গ্লোব—যেখানে পৃথিবীর আবহাওয়া, মহাসাগরীয় প্রবাহ, ও গ্রহের গঠন রিয়েল টাইমে দেখা যায়।
শিক্ষা ও গবেষণার সুযোগ
সায়েন্স সিটি শুধু বিনোদনের কেন্দ্র নয়—এটি এক বিশাল শিক্ষা ও গবেষণা ক্ষেত্র।
প্রতি বছর এখানে অনুষ্ঠিত হয় বিজ্ঞান মেলা, কর্মশালা, স্কুল প্রতিযোগিতা, ও বৈজ্ঞানিক সেমিনার।
এখানে শিশু ও তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বিজ্ঞানচর্চার আগ্রহ বাড়াতে বিশেষ প্রশিক্ষণ ও প্রদর্শনী পরিচালিত হয়।
সবুজ পরিবেশ ও বিনোদন
সায়েন্স সিটির চারপাশে বিস্তৃত সুন্দর উদ্যান, জলাশয় ও হাঁটার রাস্তা—যা একে এক অনন্য বিনোদনস্থল করে তুলেছে।
এখানে পরিবার, বন্ধু বা স্কুলের দল নিয়ে ঘুরতে গেলে দিনটা কেটে যায় অজান্তে।
ভেতরে রয়েছে রেস্তোরাঁ, ক্যান্টিন, সুভেনির দোকান ও আরামদায়ক বসার জায়গা।
শেষকথা
কলকাতার সায়েন্স সিটি কেবল একটি মিউজিয়াম নয়—এটি বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও কল্পনার এক জীবন্ত বিশ্ব।
এখানে শিশুরা শেখে বিজ্ঞানের রহস্য, তরুণরা খোঁজে ভবিষ্যতের প্রযুক্তি, আর প্রাপ্তবয়স্করা ফিরে পান শৈশবের কৌতূহল।
সত্যিই, সায়েন্স সিটি এক এমন জায়গা যেখানে জ্ঞান আর আনন্দ হাত ধরাধরি করে চলে।
প্রতিটি দর্শকের মনেই জন্ম নেয় নতুন প্রশ্ন—“আর কী কী জানা বাকি আছে এই বিশাল জগতে?”
এবং সেই প্রশ্নই তো বিজ্ঞানের আসল শুরু।












Leave a Reply